ছাত্র-জনতার এক দফা দাবির মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। এরপরই সারা দেশে ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট শুরু হয়। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশের সদস্যদের ওপর হামলা-নির্যাতন শুরু হলে অনেক সদস্য নিহত হন। এতে থানাসহ পুলিশের সব ইউনিট থেকে সটকে পড়েন পুলিশ সদস্যরা।
তবে প্রায় চার দিন পর শুক্রবার (৯ আগস্ট) সকাল থেকে রাজধানীর প্রতিটি থানায় পুলিশ সদস্যদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন ও কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশ দেন নতুন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম। সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধান ও নিরাপত্তায় পুলিশ সদস্যরা থানায় আসেন কিন্তু এখনও আতঙ্ক কাটেনি তাদের। পুলিশের পোশাক পরতেও এখন ভয় পাচ্ছেন সদস্যরা।
এদিকে পুলিশ সদস্যদের জীবনের নিরাপত্তা ও পুলিশ সংস্কারে ১১ দফা দাবিতে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আন্দোলন করছেন তারা।
গত মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) রাতে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসাবে নিয়োগ পান মো. ময়নুল ইসলাম। পরদিন বুধবার বিকাল এক সংবাদ সম্মেলনে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সব পুলিশ সদস্যকে নিজ নিজ থানা ও ইউনিটে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন।
গত বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) নোবেলজয়ী ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে ১৭ উপদেষ্টার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এরপর শুক্রবার (৯ আগস্ট) থেকে সেনাবাহিনীর সহায়তায় রাজধানীর প্রতিটি থানায় পুলিশ সদস্যদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন ও জনসাধারণকে সেবা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সরেজমিনে শুক্রবার রাজধানীর ছয়টি থানা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটা থানার সামনে ও ভেতরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে রেখেছেন। এখনও থানাগুলোয় সব পুলিশ সদস্য যোগ দেননি। যারা এসেছেন, তারাও পুলিশের পোশাক না পরে সাধারণ পোশাকে আছেন। কেউ কেউ এসে হাজিরা দিয়ে আবার চলে যাচ্ছেন। থানায় থাকতেও তারা নিরাপদ বোধ করছেন না। পুলিশি সেবা নিতেও আসছে না সাধারণ মানুষ।
এ বিষয়ে পুলিশ সদস্যরা জানান, সরকার পুলিশ সদস্যদের রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করেছে। তাদের নিয়ে জনগণের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। পুলিশ বাহিনীকে সরকারের লাঠিয়াল ও নির্যাতন বাহিনীতে রূপ দেওয়া হয়েছে। সে জন্য পুলিশের পোশাক পরিবর্তনসহ ১১ দফা দাবি জানান তারা। এ ছাড়া পুলিশের পোশাকে হামলা ও মৃত্যুর ভয়ে তারা পোশাক পড়তে অনিহা প্রকাশ করেন। পুলিশের পোশাক পরায় কোনও কোনও পুলিশ সদস্য মৃত্যুর হুমকি পাচ্ছেন বলেও জানা যায়।
তেজগাঁও থানায় গিয়ে দেখা যায়, সকালে সেনাবাহিনীর সহায়তায় থানায় পুলিশ সদস্যরা এসে পুলিশি কার্যক্রম শুরু করেছেন। এরপর পুলিশের পোশাক পরায় অফিসাস ইনচার্জকে (ওসি) মোবাইল ফোনে কয়েকজন পুলিশ সদস্য মৃত্যুর হুমকি দেন। পরে ওসিসহ সবাই পুলিশের পোশাক খুলে ফেলেন। সকালে থানায় অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্য এলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশির ভাগ সদস্য চলে যান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘সকালে তেজগাঁও থানার কার্যক্রম শুরু নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এরপর পুলিশের কয়েকজন সদস্য ওসিকে ফোন করে গালমন্দ ও মেরে ফেলার হুমকি দেন। এখনও বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। বিশেষ করে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা নিয়ে বেশি আতঙ্কে আছেন।’
বেলা সাড়ে ৩টার দিকে বনানী থানায় গিয়ে কয়েকজন কনস্টেবল ছাড়াও কাউকে দেখা যায়নি। অফিসার ইনচার্জ, পরিদর্শক ও ডিউটি অফিসার থেকে শুরু করে কোনও উপপরিদর্শক ছিলেন না থানায়। এ সময় আলেয়া নামে এক ভুক্তভোগী তার বাচ্চাকে নিয়ে থানায় আসেন। তিনি অনেক্ষণ থানায় অপেক্ষা করে কাউকে না পেয়ে ৪টার দিকে চলে যান।
জানতে চাইলে কনস্টেবল তাজুল ইসলাম বলেন, ‘সকালে ওসি স্যারসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য থানায় এসেছিলেন। পরে তারা নামাজের আগে চলে যান। এখনও সবাই থানায় কাজে যোগ দেননি।’
রমনা মডেল থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার সামনে ও ভেতরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা থানার নিরাপত্তায় পাহারা দিচ্ছেন। থানায় ডিউটি অফিসার কক্ষে উপপরিদর্শক আসাদুজ্জামানসহ (এসআই) দুজন সদস্যকে দেখা যায় সাধারণ পোশাকে।
জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এখনও আমাদের মধ্যে জীবনের হুমকি রয়েছে। পুলেশের পোশাক পরলে হামলার ভয় রয়েছে। তাই পরছি না। তবে ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে থানায় আসছি।’
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া বলেন, ‘সকাল থেকে একজন সেবাগ্রহীতা থানায় এসেছেন। সাধারণ মানুষদের সেবা দিতে আমরা প্রস্তুত। পুলিশ জনগণের বন্ধু, জনগণের জন্যই পুলিশ।’
পল্টন মডেল থানায় গিয়ে দেখা যায়, পুরো থানা পুড়ে গেছে। আপাতত থানার ভেতরে পুলিশের কার্যক্রম করা সম্ভব নয়। তবে সকালে শতাধিক পুলিশ সদস্য এসে হাজিরা খাতায় নাম লিখে তারা আবার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে চলে গেছেন।
থানার নিরাপত্তায় থাকা বাংলাদেশ আনসারের নায়েক মুজিব কুচ বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, থানায় এখন কোনও পুলিশ সদস্য নেই। সকালে অনেকে এসে হাজিরা খাতায় নাম লিখে চলে গেছেন। পুরো থানা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় শাহবাগ থানায় দিয়ে দেখা যায়, ডিউটি অফিসারের রুমে দুজন উপপরিদর্শক (এসআই) ছাড়া থানায় আর কোনও পুলিশ সদস্য নেই। তারাও পুলিশের পোশাক পরেননি।
জানতে চাইলে এসআই মাইনুল ইসলাম খান পলক বলেন, ‘আমাদের এখনও কিছু ভয়ভীতি আছে ঠিকই। তবে আমরা পুলিশের সংস্কার, রাজনৈতিক মুক্ত পুলিশ বাহিনী ও পোশাকের পরিবর্তনসহ ১১ দফা দাবি জানিয়েছি। তাই আমরা আপাতত পুলিশের পোশাক ছাড়াই দায়িত্ব পালন করছি।’
আপনার মতামত জানানঃ