ক্ষমতার দম্ভ ও জবাবদিহিহীন শাসনব্যবস্থা কী পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, তার সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হলো কোটা সংস্কার আন্দোলনে অকল্পনীয় নৃশংসতা এবং দুই শতাধিক মানুষ হতাহতের ঘটনা।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল একেবারেই শান্তিপূর্ণ একটি আন্দোলন। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বহাল করে উচ্চ আদালতের এক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে গত জুন মাসে যে আন্দোলন শুরু হয়, তা শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশের মধ্যেই সীমিত ছিল।
কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার আদালতের দোহাই দিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়াকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি আলোচনা পর্যন্ত করতে রাজি হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে জুলাইয়ের শুরুতে আন্দোলন খণ্ডকালীন সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ পর্যায়ে প্রবেশ করে। তখনো আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল।
আন্দোলনে সহিংসতা শুরু হয় ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ কর্তৃক বহিরাগত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানোর ঘটনার মধ্য দিয়ে।
পুলিশ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলা এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে ১৬ জুলাই ছয় তরুণ নিহত হন। এ ন্যক্কারজনক ঘটনার পরও সরকারের টনক নড়েনি। নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে যদি তখনো সরকার পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগকে মাঠ থেকে তুলে নিয়ে কোটা সংস্কারবিষয়ক দাবির ব্যাপারে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করত, তাহলে হয়তো পরবর্তী নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলো এড়ানো যেত।
কিন্তু আমরা দেখলাম, ছয়টি তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ার পরও সরকার বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বলপ্রয়োগের পথ থেকে সরল না। এর ফলে পুলিশ ও সরকার-সমর্থকদের হামলা ও সংঘর্ষে এক সপ্তাহের মধ্যে কমপক্ষে ২১০ জন খুন হলেন, যা বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
নিহত ১৭৫ জনকে নিয়ে করা এক বিশ্লেষণ অনুসারে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তী বিক্ষোভ-সংঘর্ষে বেশি নিহত হয়েছেন শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবী মানুষ। নিহত ব্যক্তিদের ৭১ শতাংশ শিশু, কিশোর ও তরুণ। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২২টি শিশু ও কিশোর, যার মধ্যে তিন বছর বয়সী শিশুও রয়েছে। আর ১৮ থেকে ২৯ বছরের তরুণ ১০৩ জন। ১৭৫ জনের মধ্যে শিক্ষার্থী ৪৬ জন, অর্থাৎ ২৬ শতাংশ।
নিহত ব্যক্তিদের ১৭৫ জনের মধ্যে সরাসরি রাজনৈতিক-সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ছয়জনের, যাঁদের তিনজন আওয়ামী লীগের ও তিনজন বিএনপি–সংশ্লিষ্ট। নিহত ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ শ্রমজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দোকানকর্মী, গাড়িচালক, শ্রমিক ও স্বল্প আয়ের মানুষ, যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও অন্যান্য আর্থসামাজিক কারণে ক্ষুব্ধ মানুষকে বিক্ষোভে নেমে আসার ইঙ্গিত দেয়।
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৩৭ জন, অর্থাৎ ৭৮ শতাংশের শরীরে প্রাণঘাতী গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। ছররা গুলি ও রাবার বুলেটে নিহতের সংখ্যা তুলনামূলক কম, ২২ জন। অর্থাৎ বিক্ষোভ দমনে প্রাণঘাতী গুলি ছোড়া না হলে নিহতের সংখ্যা এত বেশি হতো না।
সাধারণত গণ-আন্দোলনের সময় হাজার হাজার মানুষ যখন রাস্তায় নেমে আসে, তখন মানুষের মধ্যে একটা বিশ্বাস থাকে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো আর যা-ই করুক, তাদের ওপর সরাসরি গুলি চালাবে না।
বিক্ষোভ মিছিলে অল্পসংখ্যক মানুষ থাকলে যে ভয় থাকে, বেশি মানুষ থাকলে সে ভয় থাকে না। এর একটা কারণ, বেশি মানুষের সম্মিলিত শক্তি। আরেকটা কারণ হলো এ ধারণা করা যে বেশিসংখ্যক মানুষের ওপর কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনী গুলি চালানোর সাহস করবে না।
এটা একটা রেডলাইন বা চূড়ান্ত সীমারেখা। সামরিক শাসক কিংবা বিদেশি দখলদার বাহিনী হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। এই দুটি ক্ষেত্র ছাড়া দুনিয়ার যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কখনো এই ‘রেডলাইন ক্রস’ করে না।
আধুনিক রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সামরিক-বেসামরিক বাহিনীগুলোর হাতে অনেক ধরনের মারণাস্ত্র থাকে—মেশিনগান, ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার গানশিপ ইত্যাদি। এগুলো ব্যবহার করলে মুহূর্তের মধ্যে অনেক মানুষ হত্যা করা সম্ভব। কিন্তু ন্যূনতম গণতন্ত্র আছে, এমন কোনো দেশের বাহিনীই এসব অস্ত্র নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে নির্বিচার বা যেনতেনভাবে ব্যবহার করে না। এটা করার কোনো আইনি বা সাংবিধানিক অধিকার তাদের নেই।
এই ‘রেডলাইন ক্রস’ করা মানে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের চুক্তি ভঙ্গ। জনগণ রাষ্ট্রের হাতে বলপ্রয়োগের একচেটিয়া ক্ষমতা দিয়েছে এই শর্তে যে এই বলপ্রয়োগ করা হবে জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায়, জনগণকে হত্যার জন্য নয়।
এসব ক্ষেত্রে তাই ন্যূনতম গণতান্ত্রিক দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নন-লিথাল (প্রাণঘাতী নয়) অস্ত্র ব্যবহার করে। কাঁদানে গ্যাস শেল ছুড়ে, লাঠিপেটা করে বা জলকামান ব্যবহার করে নানাভাবে মানুষকে ছত্রভঙ্গ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।
কখনো গুলি ছুড়তে হলেও এমন নির্বিচার গুলি ছোড়ে না যে আন্দোলনকারী থেকে শুরু করে পথচারী, দোকানদার, রিকশাচালক, হকার, বাসার ছাদ কিংবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শিশুরা পর্যন্ত মারা যেতে পারে।
নির্বিচার ছররা গুলি মেরে সাধারণ মানুষের বুক ঝাঁঝরা করা কিংবা চোখ নষ্ট করে দেওয়া ঔপনিবেশিক দখলদার বাহিনী ছাড়া কোনো সভ্য দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করতে পারে না। কেননা প্রতিটি গুলির জন্য তাদের জবাবদিহি করার কথা।
একবার এই ‘রেডলাইন’ অতিক্রম করলে সেই সরকারের আর ক্ষমতায় থাকার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এটা দেশের মানুষের কাছে যেমন, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এর আগেও বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে।
তাদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম থেকে শুরু করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের মিছিল-মিটিংয়ে দমন-পীড়ন, এমনকি গুলি করে মানুষ হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এগুলোও একেকটা ‘রেডলাইন’, যা কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের অতিক্রম করার কথা নয়।
তবে এবার গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায় কর্তৃত্ববাদী দম্ভ নিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকার যে ‘রেডলাইন’টি অতিক্রম করল, তার মাত্রা একেবারেই ভিন্ন। কোনো একটা মিছিলে হঠাৎ আক্রমণ করা, কাউকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া কিংবা রাতের আঁধারে কোথাও অভিযান চালিয়ে মানুষ হত্যা আর একটানা কয়েক দিন ধরে দেশজুড়ে রাস্তায় নেমে আসা হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ওপর প্রকাশ্যে নির্বিচার গুলিবর্ষণ একেবারেই ভিন্ন বিষয়।
এত হতাহতের পরও সরকারের দিক থেকে অনুতপ্ত হওয়া, ভুল স্বীকার করা কিংবা হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার কোনো বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। ৭০টি মামলা বিশ্লেষণ করে সমকাল লিখেছে, জুলাই হত্যাকাণ্ডের পর যেসব মামলা করা হয়েছে, সেগুলোর কোনোটিতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ প্রকাশ্যে পুলিশের গুলিতে নিহত হলেও মামলার এজাহারে আন্দোলনকারীর ছোড়া গুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপে সাঈদ মারা গেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (গুলিতে শিক্ষার্থী নিহতের তথ্য নেই কোনো মামলায়; সমকাল, ৩০ জুলাই ২০২৪)
শুধু তা-ই নয়, যথাযথ তদন্ত ছাড়াই হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ ও বিরোধী দলের কর্মীদের ব্লক রেইড দিয়ে পাইকারি হারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
প্রথম আলোর খবর বলছে, ২৯ জুলাই সোমবার পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ২৪৩টি মামলায় যে ২ হাজার ৬৩০ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে ২ হাজার ২৮৪ জনেরই কোনো রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি অর্থাৎ গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের ৮৭ শতাংশই শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষ। (ঢাকায় গ্রেপ্তার ৮৭ শতাংশের রাজনৈতিক পরিচয় নেই; প্রথম আলো, ৩১ জুলাই ২০২৪)
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিরাপত্তা হেফাজতের নামে তুলে নিয়ে গিয়ে ডিবি অফিস থেকে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি দেওয়ানো হয়েছে। সারা দেশে বিনা বিচারে হত্যা, গুম-খুন, মিথ্যা মামলা ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ন্যায়সংগত বিক্ষোভ কর্মসূচি পর্যন্ত পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের।
গত ২৯ জুলাই সোমবার ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের মিছিলে ছাত্রলীগ হামলা চালায়, পুলিশ লাঠিপেটা করে এবং বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। কুমিল্লায় আন্দোলনে যোগ দিতে যাওয়ার সময় এক শিক্ষার্থীকে গুলি করার ঘটনা ঘটে। (বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, লাঠিপেটা, আটক; প্রথম আলো, ৩০ জুলাই ২০২৪)
এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকার ক্রমেই আরও বেশি নিপীড়নকারী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সরকার বলপ্রয়োগ ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ দেখাতে চাইলেও এভাবে কোনো দেশ চলতে পারে না। অবিলম্বে শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ ও বিরোধী নেতা-কর্মীদের ওপর চলমান দমন-পীড়ন ও গণগ্রেপ্তার বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করার দাবি উঠেছে।
বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকার নিজেই এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত বলে তদন্ত ও বিচার বিশ্বাসযোগ্য করতে হলে তা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করতে হবে, এমন দাবিও করেছেন কেউ কেউ। সরকারকে প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান, আহতদের সুচিকিৎসা এবং পঙ্গু ও অন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের যথাযথ পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ