বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে গ্রেফতার হয়ে জেলে গিয়েছিলেন একবারই এবং সেটি হয়েছিলো ২০০৭ সালে বাংলাদেশে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।
চাঁদাবাজির এক মামলায় ওই বছরের ১৬ই জুলাই সোমবার ভোরে তাকে তার ধানমণ্ডির বাসা ‘সুধা সদন’ থেকে গ্রেফতার করে সরাসরি আদালতে নিয়ে যায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আদালতে শুনানি শেষে তাকে নেয়া হয়েছিলো শেরে বাংলা নগরে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় বিশেষ ভাবে তৈরি সাবজেলে।
প্রায় এগার মাস বন্দী থাকার পর তিনি ২০০৮ সালের ১১ই জুন জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরে বিদেশে যান চিকিৎসার জন্য। এরপর নানা নাটকীয়তা শেষে দেশে ফেরার পর তার নেতৃত্বেই সে বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সাত বছর পর আবার ক্ষমতা ফেরে আওয়ামী লীগ।
শেখ হাসিনা জেলে যাওয়ার প্রায় দুই মাস পর তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকেও দুর্নীতির মামলায় জেলে যেতে হয়। তাকেও রাখা হয়েছিলো সংসদ ভবন এলাকার আরেকটি সাবজেলে।
পরে তিনিও জামিনে মুক্তি পেয়ে বের হন এবং ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেন। প্রসঙ্গত, ১৯৭৫ সালের পনের অগাস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের সময় বড় মেয়ে শেখ হাসিনা তার ছোট বোন শেখ রেহানার সাথে বিদেশে ছিলেন।
পরে ১৯৮১ সালের সতেরই মে দেশে ফিরে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেন। তিনি জেলে যাওয়ার পর তার অনুপস্থিতিতে দল পরিচালনার জন্য দলের তখনকার প্রবীণ নেতা জিল্লুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা তখন বাস করতেন ধানমণ্ডির সুধা সদনে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত হয়ে ওঠে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা।
অর্থাৎ দুই প্রধান রাজনৈতিক নেতা- শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বাদ দেয়ার বিষয়টি। দুই প্রধান রাজনৈতিক দল -আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতেও সংস্কারপন্থী অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠেছিলো দুই নেত্রীকে বাদ গিয়ে দল পুনর্গঠন চেষ্টার অংশ হিসেবে।
সে কারণেই রাজনৈতিক অঙ্গনে দুই নেত্রীকে আটকের সম্ভাবনার বিষয়টি আগে থেকেই আলোচনা হচ্ছিলো। তার আগেই ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছিলো নির্বাচন কমিশন।
গ্রেফতার হওয়ার পর আদালতে শেখ হাসিনা বলেছেন ‘তার নির্বাচনে অংশ নেয়া ঠেকাতেই সরকার তাকে গ্রেফতার করেছে’। তার গ্রেফতারকালীন পরিস্থিতি নিয়ে পরদিন ১৭ই জুলাই দৈনিক প্রথম আলোতে লেখা হয়েছিলো ‘যেভাবে সুধা সদনে অভিযান’।
ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে “…. শেখ হাসিনা গ্রেফতার হতে পারেন- এমন আলোচনা কয়েক দিন ধরেই বিভিন্ন মহলে চলছিল। আর এ ধারণা থেকেই তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও রোববার (২০০৭ সালের ১৫ই জুলাই) মধ্যরাতে কিছু সাংবাদিককে ওই এলাকায় ঘুরতে দেখা যায়।”
এরপর গুঞ্জন আরও বাড়লে রাত চারটার দিকে আরও অনেক সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত হন। ভোর সাড়ে চারটার দিকে পুলিশের একটি গাড়ি সুধা সদনের কাছে গিয়ে থামে।
ওই রিপোর্টে বলা হয়, “… পৌনে পাঁচটার দিকে খুব দ্রুতগতিতে কালো গ্লাসের একটি মাইক্রোবাস ও দুটি হুন্দাই জিপ পাঁচ নম্বর সড়কে ঢোকে। এর পিছু পিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের নিয়ে তিনটি বাস ঢুকে পড়ে। মুহূর্তেই আরও দুটি বড় বাস, অর্ধশতাধিক কার, জিপ, মাইক্রোবাস, পিকআপে করে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা সুধা সদনের সামনে ও আশেপাশের সড়কে অবস্থান নেয়।”
মূলত: এর পরপরই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনসহ পুরো এলাকা ঘিরে ফলে। সুধা সদনের সামনের সড়কে ব্যারিকেড দেয়া হয়। ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছিলো তখন এবং সেই বৃষ্টির মধ্যে র্যাব ও পুলিশের সদস্যরা বিভিন্ন সড়কে টহল দিতে থাকেন এবং মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয়।
কিছুক্ষণের মধ্যে সুধা সদনের সামনে আসে একটি বড় প্রিজন ভ্যান। এরপরও আরও দুই তিনটি গাড়ি সুধা সদনের প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে দাড়ায় এবং কর্মকর্তারা ভেতরে প্রবেশ করেন।
বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী পুলিশ কর্মকর্তারা ভেতরে প্রবেশ করে বাড়ির বিভিন্ন কক্ষে তল্লাশি চালান। শেখ হাসিনার কক্ষের দরজায় নক করার প্রায় এক ঘণ্টা পর তিনি দরজা খোলেন বলে সংবাদগুলোতে তথ্য এসেছিলো।
তখন শেখ হাসিনা যৌথ বাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান যে, তাকে কিসের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং কোন কাগজপত্র আছে কি না। কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট দেখানোর পর তিনি প্রস্তুত হবার জন্য সময় চেয়ে নেন।
পরে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে একটি জিপে করে কড়া প্রহরায় তাকে নেয়া হয় ঢাকার একটি আদালতে। এসময় পুরো পথ জুড়ে ছিলো যৌথ বাহিনী সদস্যদের কড়া অবস্থান। এসময় তার দলের অনেক নেতাকর্মী সুধাসদন থেকে গাড়ি অনুসরণ করে আদালত এলাকায় যান।
সেই রাত থেকে আদালতে নেয়া পর্যন্ত পুরো সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক রাশিদুল হাসান। মি. হাসান বিবিসিকে জানান, তিনি খবর পেয়ে রাত দুইটার দিকে সুধাসদন এলাকায় গিয়েছিলেন।
“আমি গিয়ে দেখি আরও সংবাদকর্মীরা আসছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো যে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। ভোর হওয়ার আগেই দেখলাম যৌথ বাহিনী পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলো। সুধা সদনের বাইরে গলির মুখে ব্যারিকেড দিয়ে আমাদের পথ বন্ধ করে দেয়া হলো।”
”সকালে তাকে যখন আদালতে নেয়ার জন্য সুধাসদন থেকে বের করা হলো তখন তার গাড়িকে ঘিরে ছিলো নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা। আর বাইরে ছিলো তার দলের নেতাকর্মীরা।”
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী রাত দুইটায় শেখ হাসিনার নিরাপত্তা রক্ষীদের প্রত্যাহার করা হয়েছিলো। রাত সাড়ে চারটায় যৌথ বাহিনীর ৪০টা গাড়ি সেখানে পৌঁছায়। ভোর পৌনে পাঁচটায় সুধা সদনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে যৌথ বাহিনী।
ভোর পাঁচটা সাত মিনিটে তারা সুধা সদনে প্রবেশ করে। আর সাতটা ২৮ মিনিটে শেখ হাসিনাকে বাইরে নিয়ে আসে তারা। সাতটা ৫০ মিনিটে তাকে সিএমএম কোর্টে তোলা হয় এবংআটটা ২০ মিনিটে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে শেখ হাসিনা আদালতে তার বক্তব্য দেন।
সকাল সোয়া ১০টায় যৌথ বাহিনীর কনভয় শেখ হাসিনাকে নিয়ে সাবজেলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। আর সাড়ে দশটায় জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের বিশেষ কারাগারে নেয়া হয় তাকে।
দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের পরপরই তার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় গ্রেফতারকে ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে বলেছিলেন, তার মাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, যে মামলায় শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো সে মামলার বাদী ছিলেন ব্যবসায়ী আজম জে চৌধুরী। মামলায় শেখ হাসিনা এবং শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বিরুদ্ধে দুই কোটি ৯৯ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ করা হয়েছিলো।
সুধা সদনের সূত্রকে উদ্ধৃত করে পরদিন সব পত্রিকার আরেকটি খবর আসে যে, সুধাসদন থেকে বের হওয়ার আগ মুহুর্তে শেখ হাসিনা যৌথ বাহিনীর কাছে জিজ্ঞেস করেন, তিনি কয়েকটি ফোন করতে পারেন কি না।
তাদের দিক থেকে ইতিবাচক উত্তর এলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত তার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়ের সাথে কথা বলেন। এরপর তিনি কথা বলেন দলীয় নেত্রী সাহারা খাতুন (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যিনি পরে মারা গেছেন) সহ দলের কয়েকজন নেতাকে। এরই কোন এক পর্যায়ে তিনি ফোন করেন তখনকার আইন উপদেষ্টা মইনুল হোসেনকে।
দ্য ডেইলি স্টারের খবর অনুযায়ী, শেখ হাসিনা সে সময় তাকে বলছিলেন “কাজটা আপনারা ভালো করেননি। আমি শিগগিরই মুক্ত হয়ে বের হয়ে আসবো এবং তখন কাউকে ছাড়া হবে না। এমনকি আপনাকেও না।”
১৭ বছর আগে শেখ হাসিনা কারাগারে যাওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তৎকালীন আইন উপদেষ্টা মইনুল হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, আইনি বাধ্যবাধকতার কারণেই শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।।মি. হোসেন পরে আওয়ামী লীগ আমলে দুইটি মামলায় দু’দফায় জেল খেটেছেন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি মারা গেছেন।
আর ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরে প্রথমে সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমেদ এবং পরে তখনকার সেনা প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ বাংলাদেশ ছেড়ে যান। এরপর তারা আর দেশে ফেরেননি।
গ্রেফতারের আগ মূহুর্তে দেশবাসী ও নিজ দলের নেতাকর্মী সমর্থকদের উদ্দেশ্যে নিজের হাতে চিঠি লিখেন শেখ হাসিনা। সেই চিঠিতে তার গ্রেফতারে মনোবল না হারানোর জন্য সবার কাছে তিনি আহ্বান জানান।
চিঠিতে তিনি বলেন, “প্রিয় দেশবাসী, আমার সালাম নেবেন। আমাকে সরকার গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায়, জানি না। আমি আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেই সারাজীবন সংগ্রাম করেছি।
জীবনে কোন অন্যায় করিনি। তারপরেও মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। উপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও আপনারা দেশবাসী, আপনাদের ওপর আমার ভরসা”। চিঠিতে তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের মনোবল না হারাতে বলেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে বলেন।
“…আমি আছি আপনাদের সঙ্গে, আমৃত্যু থাকবো। আমার ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন, আপনারা বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যান..।”
পরে আদালতেও শেখ হাসিনা বলেন যে, তাকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে রাখার জন্যই ‘মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে’। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে তখনকার প্রবীণ নেতা জিল্লুর রহমান (পরে রাষ্ট্রপতি এবং প্রয়াত) গ্রেফতারের তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন যে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা কার্যকর করতেই এই গ্রেফতার’।
আপনার মতামত জানানঃ