চীনের ঋণে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার। জি টু জি (সরকার টু সরকার) পদ্ধতিতে হওয়ায় এ প্রকল্পে কোনো প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। এ পদ্ধতিতে অর্থায়নের জন্য ব্যাংক ও ঠিকাদার নির্ধারণ করে থাকে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার। সে নিয়ম মেনেই ঢাকা-আশুলিয়া প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে এক্সিম ব্যাংক অব চায়না। আর কাজটি পেয়েছে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি করপোরেশন (সিএমসি)।
এ পর্যন্ত সব ঠিক থাকলেও ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বাস্তবায়নে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয় বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান এপিক সলিউশন। ২০১৭ সালে যখন প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন দেয়া হয়, তখন সিএমসি ও এপিক সলিউশন একটি চুক্তি করে। আর সে চুক্তি অনুযায়ী, এক্সপ্রেসওয়ের কাজ সিএমসিকে পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করবে এপিক সলিউশন। বিনিময়ে এপিক সলিউশন কমিশন পাবে নির্মাণকাজের চুক্তিমূল্যের ৬ শতাংশ।
জি টু জি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নাধীন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে এভাবে তৃতীয় পক্ষের আবির্ভাবকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও সেতু বিভাগের একাধিক কর্মকর্তাও জানিয়েছেন, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে তৃতীয় পক্ষকে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়ার ক্ষেত্রে খোদ সেতু বিভাগেরই সাবেক এক সচিবের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন খাতে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ছাড়াও পদ্মা সেতু রেল সংযোগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল (কর্ণফুলী টানেল) প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে জি টু জি পদ্ধতিতে, চীনের অর্থায়নে। সরকরি ভাষ্যমতে, ভূরাজনৈতিক বিচারে বাংলাদেশের অন্যতম মিত্র দেশ চীন। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফরের পর কৌশলগত সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের অবকাঠামো, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে চীনের বিনিয়োগে গৃহীত প্রকল্পগুলোয় ঠিকাদারের কাজ প্রধানত চীনা সংস্থাগুলোই পেয়ে থাকে। আবার অন্যান্য দেশের অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পেও দেখা যায় চীনা ঠিকাদারদের আধিপত্য। আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ের মতো এসব প্রকল্পেও এমন অস্বাভাবিক ঘটনা থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জি টু জি প্রকল্প আমাদের দেশে অনেক হয়েছে। এখনো চলমান আছে। কোথাও কাজ পাইয়ে দেয়ার নামে তৃতীয় পক্ষের প্রবেশ—এ ধরনের নজির আমার চোখে পড়েনি। আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে তৃতীয় পক্ষের আবির্ভাব কোন পর্যায়ে হয়েছে, তা যাচাই-বাছাই করে দেখার দরকার আছে। আমি মনে করি এ ঘটনার সঠিক তদন্ত হওয়া উচিত।’ এক্ষেত্রে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষকে আরো সতর্ক হতে হবে, তা না হলে নির্মাণকাজ শুরুর পর নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামানের মন্তব্যের প্রতিফলন এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে। ‘কাজ পাইয়ে দিতে সহায়তা করা’ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান এপিক সলিউশনকে এখন পর্যন্ত কমিশনের ১ টাকাও দেয়নি সিএমসি। এর জেরে বাংলাদেশের আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে এপিক সলিউশন। বিষয়টি বর্তমানে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, এজেন্ট ও ঠিকাদারের মধ্যকার এ দ্বন্দ্বের কারণে বিঘ্নিত হতে পারে চলমান নির্মাণকাজই।
ঢাকার বিমানবন্দর থেকে আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল-আশুলিয়া হয়ে সাভার ইপিজেড পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুলাইয়ে একনেকে অনুমোদিত হয়। বর্তমানে প্রকল্পটির প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ১৭ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক অব চায়নার ঋণ ১০ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা।
সংবাদমাধ্যম গণমাধ্যমর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, প্রকল্পটি অনুমোদনের কম-বেশি পাঁচ মাস পর (২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর) ঠিকাদার সিএমসি ও বাংলাদেশের এপিক সলিউশনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটি হয় থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে। আর সে চুক্তি অনুযায়ী, আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ের কাজ পেতে সিএমসিকে সহযোগিতা করবে এপিক সলিউশন। এর বিনিময়ে চুক্তিমূল্যের ৬ শতাংশ কমিশন পাবে প্রতিষ্ঠানটি। ডাউন পেমেন্ট অর্থাৎ চুক্তিমূল্যের টাকা সিএমসি যখন পাবে, তার ৩০ দিনের মধ্যেই এপিক সলিউশনকে কমিশন দিয়ে দেবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এপিক সলিউশন নামের বাংলাদেশী এ প্রতিষ্ঠানটির মালিক শাহেদ রহমান বশির। এর কার্যালয় রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে। সেতু বিভাগ ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সেতু বিভাগের সাবেক একজন সচিবের সহায়তা নিয়ে চীনের ঠিকাদার সিএমসিকে আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ের কাজ পাইয়ে দিয়েছে এপিক সলিউশন।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কাজ পাওয়ার পর থেকেই এপিক সলিউশনকে উপেক্ষা করতে শুরু করে ঠিকাদার সিএমসি। ২০২২ সালের এপ্রিলে এ প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। চুক্তির সময় এপিক সলিউশনের কোনো কর্মকর্তাকেই সঙ্গে রাখেনি চীনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি।
জানতে চাইলে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘এ প্রকল্পের আওতায় চীন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ১১ হাজার কোটি টাকার চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড় হয়েছে এখন পর্যন্ত। এ মাসেই আরো ১০০ কোটি টাকার মতো অর্থ ছাড় হবে। কিন্তু এজেন্টের সঙ্গে ঠিকাদারের দ্বন্দ্বের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ানোর কারণে প্রকল্প পরিচালনায় সমস্যা হতে পারে, যা এটিকে দীর্ঘায়িত করবে বলেই আমরা আশঙ্কা করছি।’
সড়ক-মহাসড়ক, সেতু, রেলপথ কিংবা উড়ালসড়ক—বাংলাদেশে এ জাতীয় অবকাঠামোর নির্মাণ ব্যয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্মাণ ব্যয়ের দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল অবকাঠামোও নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে নির্মাণ ব্যয় বেশি হওয়ার পেছনে আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ের মতো ‘অস্বাভাবিক’ ঘটনাগুলো বিশেষভাবে ভূমিকা রেখে চলেছে।
জি টু জি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নাধীন আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেয়ার নামে কোনো তৃতীয় পক্ষের প্রবেশের সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জি টু জি আওতার প্রকল্পে তৃতীয় পক্ষ থাকার কোনো সুযোগ নেই। সেটা যদি হয়ে থাকে, তাহলে এখানে নিশ্চয় কোনো অশুভ পাঁয়তারা কাজ করেছে। কারা অশুভ পাঁয়তারা করছে সেটা বিচারিক প্রক্রিয়া বা তদন্তের মাধ্যমে উন্মোচন করা উচিত। এখানে যেহেতু একটা চাইনিজ কোম্পানি আছে এবং বাংলাদেশও আছে—আমি মনে করি উভয় পক্ষের দায় আছে।’
অন্য যেকোনো দেশের বিনিয়োগ প্রকল্পের তুলনায় চীনের বিনিয়োগ প্রকল্পে দুর্নীতির প্রবণতা বেশি বলেও মন্তব্য করেছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যেকোনো দেশের জি টু জি বা যেকোনো দেশের বিনিয়োগ আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে যে রকম দুর্নীতির প্রবণতা, চীনের ক্ষেত্রে এটা তুলনামূলক বেশি। এখানে যদি অশুভ কিছু হয়ে থাকে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’
মার্কিন থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (এইআই) এক হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে চীন থেকে মোট বিনিয়োগ এসেছে ৭০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে, যার পরিমাণ ৩২৭ কোটি ডলার। ধাতু (নির্মাণসংশ্লিষ্ট) সরবরাহ খাতে দেশটির বিনিয়োগ ২১৩ কোটি, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ১১০ কোটি ডলার। এছাড়া আর্থিক খাতে ১৬ কোটি ও অন্যান্য খাতে ৪১ কোটি ডলারের মতো বিনিয়োগ রয়েছে দেশটির। অথচ বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্পে দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে বিনিয়োগের তিন গুণেরও বেশি, প্রায় ২ হাজার ৩০০ ডলার। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেই চীনা ঠিকাদারদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি জোরালো। এছাড়া সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোয়ও চীনা ঠিকাদারদেরই আধিপত্য। এর বাইরে প্রযুক্তি, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতের প্রকল্পেও চীনা ঠিকাদারদের জোরালো উপস্থিতি রয়েছে।
এইআইয়ের চায়না গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট ট্র্যাকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে চীনা ঠিকাদারদের কাজের ব্যাপ্তি ৯০২ কোটি ডলার। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৮৩২ কোটি ডলারের কাজ পেয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো। আবাসন, কৃষি, প্রযুক্তি ও ইউটিলিটি খাতে এর পরিমাণ যথাক্রমে ২৩৬, ১২৮, ১১৩ ও ১০৪ কোটি ডলার।
আপনার মতামত জানানঃ