‘ঐতিহাসিক’ এই বছর এরই মধ্যে চার মাস পার করেছে। বেশ কিছু দেশে ভোট হয়েও গেছে। এমন এক সময়ে এই নির্বাচনগুলো হচ্ছে, যখন বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের মান নিচের দিকে নামছেই। সুইডেনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্সের ২০২৩ সালের পর্যবেক্ষণ বলছে, বিশ্বের অর্ধেক দেশে টানা ছয় বছর ধরে গণতন্ত্রের ক্ষয় চলছে।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ল্যারি ডায়মন্ড এক দশকের বেশি আগে ‘গণতান্ত্রিক মন্দা’ শব্দটির প্রচলন করেছিলেন। তাঁর মন্তব্যকেও আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। তিনি মনে করেন, প্রতিটি সময়ের একটি আবেদন থাকে এবং এই সময়টি গণতন্ত্রের নয়।
আবার বিশ্বরাজনীতিও এখন বেশ টালমাটাল। যুদ্ধ-সংঘাত, গোলযোগ ও উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে অনেক অঞ্চল। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে চলছে বিচিত্রমুখী দ্বন্দ্ব-বিরোধ ও মৈত্রীর সম্পর্ক।
ভূরাজনীতির হিসাব-নিকাশ হয়ে পড়েছে খুবই জটিল। কোনো কোনো দেশের নির্বাচন ও এর ফলাফল শুধু নিজ দেশ বা বিশ্ব গণতন্ত্রের উন্নতি-অবনতির হিসাব-নিকাশে আটকে থাকে না। প্রতিবেশী দেশ বা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতেও বড় প্রভাব ফেলে। এমনকি বিশ্বব্যবস্থার ধারা বা গতি-প্রকৃতিকেও পাল্টে ফেলে।
সবকিছু মিলিয়ে বিশ্ব গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এবং বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে ২০২৪ সালের এই নির্বাচনগুলোর শক্ত সম্পর্ক রয়েছে।
এ বছরের শুরুর চার মাসে যে দেশগুলোতে নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। বলা যায়, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই বিশ্বে শুরু হয়েছে নির্বাচনের বছর। এ সময়ে আরও নির্বাচন হয়েছে রাশিয়া, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, কম্বোডিয়া, তাইওয়ান, বেলারুশ, আজারবাইজান, সেনেগাল, এল সালভাদর, ক্রোয়েশিয়া, ফিনল্যান্ড, পর্তুগাল, মালদ্বীপ ও ভুটানের মতো বেশ কিছু দেশে। জনসংখ্যার হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে ‘বড় গণতন্ত্র’-এর দেশ ভারতে এখন নির্বাচন চলছে।
যে দেশগুলোতে এরই মধ্যে নির্বাচন হয়েছে এবং বছরের বাকি সময়ে যে দেশগুলোতে নির্বাচন হবে, সেখানে নানা মানের গণতন্ত্র রয়েছে।
২০২৪ সাল বিশ্ব গণতন্ত্রের জন্য সত্যিই এক কঠিন পরীক্ষার বছর। গণতন্ত্রের এই ক্ষয় নিয়ে বিশ্ব জুড়ে যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে তা বর্তমান হতাশাজনক পরিস্থিতি বদলাতে ভূমিকা রাখতে পারে। আবার আগে থেকে অনুমান করা ভোটের ফলের হিসাবও কখনো পাল্টে যায়। অনিয়ম, কারচুপি ও একতরফা নির্বাচনের কৌশলও অনেক সময় অকার্যকর হয়ে পড়ে।
৭০টি দেশের মধ্যে কিছু দেশে (২০২৩ সালের ফ্রিডম হাউসের ইনডেক্সে যে দেশগুলোকে ‘নট ফ্রি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে) স্বৈরাচার ভালোভাবেই জেঁকে বসেছে।
আবার কিছু দেশ আছে (‘পার্টলি ফ্রি’) যেগুলো পুরো স্বৈরতান্ত্রিক না হলেও সেখানে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে বড় ধস নেমেছে। এই দুই ধরনের দেশের নির্বাচনের ফলাফল অনেকটাই পূর্বনির্ধারিত এবং আগে থেকে ধারণা করা যাচ্ছে।
এ ছাড়া কিছু গণতান্ত্রিক দেশ আছে, যেখানে উদারপন্থী রাজনৈতিক ধারণার বিপরীতে রক্ষণশীল ধরার এখন বাড়বাড়ন্ত অবস্থা। তা ছাড়া অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি, শাসনব্যবস্থার দুর্বলতাসহ নানা কারণে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। আবার স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন হবে, এমন কিছু দেশও রয়েছে।
এর বাইরে সামরিক শাসন চলছে বা অভ্যন্তরীণ সংঘাত রয়েছে—এমন কিছু দেশের শাসকেরাও এ বছর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই নির্বাচনগুলোর পরিণতি কী বা শেষ পর্যন্ত আদৌ হবে কি না, তা বলা কঠিন। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে মার্চ মাসে যে ভোট হওয়ার কথা ছিল, এরই মধ্যে সেখানকার সেনা সরকার তা স্থগিত করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে নির্বাচনগুলো হয়েছে বা সামনে হবে, সেগুলো কেমন হয়েছে বা হবে? বিশেষ করে যেসব দেশগুলোতে এরই মধ্যে স্বৈরাচার নিজের জমিন শক্ত করে ফেলেছে, অথবা যেসব দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামো ও মূল্যবোধে ধস নেমেছে এবং স্বৈরাচার শিকড় গাঁড়তে শুরু করেছে, সেখানে নির্বাচনগুলোর ভূমিকা কী? এর সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক কতটুকু? এই নির্বাচনগুলো নামতে থাকা গণতন্ত্রের মানকে আরও নিচে নামাবে, নাকি নতুন কোনো আশাবাদ জাগাবে?
ভূরাজনৈতিক দিক থেকে দেখলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এই নির্বাচনগুলো কী ভূমিকা রাখবে, সেই প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্ভবত আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয়ও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। নির্বাচনে কে জিতবেন, তাঁর ওপর নির্ভর করবে আগামী দিনের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র কোন পথে হাঁটবে। পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে সম্ভাব্য দুই প্রার্থী জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে ফারাকটি খুবই বিস্তর।
যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎও এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে বলে মনে করেন দেশটির অধিকাংশ নাগরিক। অ্যাসোসিয়েট প্রেস ও এনওআরসি সেন্টার ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের জরিপ তা-ই বলছে। ৬২ শতাংশের মতো ভোটার মনে করেন যে আগামী নির্বাচনের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন ডগলাস ব্রিঙ্কলি। তিনি মনে করেন, ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরলে যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ইতি এবং সেখানে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থার সূচনা ঘটতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফলের ওপর বিশ্ব গণতন্ত্রের ভাগ্যও নির্ভর করছে। অধ্যাপক ল্যারি ডায়মন্ড মনে করেন, ট্রাম্পের ফিরে আসা আমেরিকার গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকে যেমন পরীক্ষায় ফেলে দেবে, তেমনি দেশে দেশে শিকড় গেড়ে বসা স্বৈরাচারী শাসকদেরও উৎসাহিত করবে।
গত চার মাসে বাংলাদেশ, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, কম্বোডিয়া, বেলারুশ বা আজারবাইজানের মতো দেশগুলোতে যে নির্বাচন হয়ে গেল, তাতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। এসব দেশে নির্বাচনগুলো হয়েছে কোনোটি একতরফাভাবে, কোনোটি নিয়ন্ত্রিত, কোনোটি কার্যকর বিরোধী দলকে বাইরে রেখে এবং বিরোধীদের ওপর ধারাবাহিক দমন-পীড়ন অব্যাহত রেখে। আবার কোনো দেশে হয়েছে এসব নানা কৌশলের সমন্বয়ে।
ভারতে সাত ধাপ নির্বাচনের মাত্র দুটি হয়েছে। কিন্তু প্রথম ধাপের ভোটের পর ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর যে কৌশল ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে দেখা গেল, তা ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিক অবনমনেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অভিবাসন ইস্যুর মতো সমস্যার কারণে ইউরোপজুড়ে ডানপন্থা ও জনতুষ্টিবাদী ধারা জনসমর্থন পেতে শুরু করেছে। গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য এগুলোও ভালো লক্ষণ নয়। ফিনল্যান্ড ও পর্তুগালের নির্বাচনে এরই মধ্যে ডানপন্থীরা ভালো করেছে।
গত বছরের নভেম্বরে নেদারল্যান্ডসের নির্বাচনেও তেমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম ও ক্রোয়েশিয়ায় এ বছর যে নির্বাচনগুলো হতে যাচ্ছে, সেখানে ডানপন্থীরা ভালো করবে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ জুনের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনের ফলাফলের ক্ষেত্রেও একই আশঙ্কা রয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে দেশে গণতন্ত্রের এই করুণ দশা কেন? সুইডেনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্সের প্রধান ও কোস্টারিকার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন কাসাস-জামোরা এর কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন।
প্রথমত, তিনি মনে করেন, গণতন্ত্র সামাজিক চাহিদার প্রতি দ্রুত সাড়া দিতে পারে না, এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতিকে উপেক্ষা করার একটি মনোভাব জনমনে তৈরি হয়েছে।
তৃতীয়ত, সামাজিক ক্ষেত্রে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে যাওয়ায় কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তিত্বের প্রতি মানুষের ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।
চতুর্থত, ইরাক আক্রমণ, অর্থনৈতিক সংকট এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলার ক্ষেত্রে পশ্চিমের নৈতিক কর্তৃত্ব দুর্বল করে দিয়েছে এবং এসব কারণেই আজ গণতন্ত্রের এই দুর্দশা।
এ বছর ৭০টিরও বেশি দেশে নির্বাচন হচ্ছে—গণতন্ত্রের শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্য এটা একটা উদ্যাপনের বছর হিসেবেই বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু গত চার মাসে যে নির্বাচনগুলো হলো, তার অভিজ্ঞতা কী? অনেকগুলো নির্বাচন তো গণতন্ত্রের জন্য বেশ খারাপ দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছে। আর সামনে যে নির্বাচনগুলো হবে, সেগুলো নিয়ে খুব আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে কি?
আগেই বলেছি, বিশ্বে যে দেশগুলোতে (নট ফ্রি ও পার্টলি ফ্রি) স্বৈরশাসক বা আধা স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতায় আছেন, সেই নির্বাচনগুলোর ফলাফল কী হবে, তা আগেই জানা থাকে।
গত চার মাসে হয়ে যাওয়া নির্বাচনগুলোতে তার প্রমাণ মিলেছে। সামনে যে নির্বাচনগুলো হতে যাচ্ছে, সেখানে এর উল্টো কিছু ঘটবে, এমনটা আশা করা কঠিন। আবার যে কয়েকটি দেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, সেখানেও কারচুপি, অনিয়মের ঝুঁকি আছে।
এখন ইইউ পার্লামেন্ট ও ইউরোপের দেশগুলো, যেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে ধরে নেওয়া হয়, সেখানকার ফলাফলে যদি ডানপন্থার উত্থান দেখা যায় এবং সব শেষে নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে যদি ট্রাম্পের বিজয় নিশ্চিত হয়, তবে গণতন্ত্রের পতনের ষোলোকলা পুরো হবে।
২০২৪ সাল বিশ্ব গণতন্ত্রের জন্য সত্যিই এক কঠিন পরীক্ষার বছর। গণতন্ত্রের এই ক্ষয় নিয়ে বিশ্ব জুড়ে যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে তা বর্তমান হতাশাজনক পরিস্থিতি বদলাতে ভূমিকা রাখতে পারে। আবার আগে থেকে অনুমান করা ভোটের ফলের হিসাবও কখনো পাল্টে যায়। অনিয়ম, কারচুপি ও একতরফা নির্বাচনের কৌশলও অনেক সময় অকার্যকর হয়ে পড়ে।
গণতন্ত্র এখন একটি খারাপ সময় পার করছে ঠিকই কিন্তু ইতিহাস বিবেচনায় নিলে আশা ধরে রাখারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ গণতন্ত্র ধারাবাহিকভাবে বিশ্বকে অধিক গণতান্ত্রিক দিকেই নিয়ে গেছে। সূত্র: প্রথম আলো।
আপনার মতামত জানানঃ