রোহিঙ্গা সংকটের তিন বছরের বেশী সময় পার হলো কিন্তু আজও এই সংকট নিরসনে কোনো বাস্তবমুখী পদক্ষেপ কার্যকর সম্ভব হয়নি। ঘটনার সূচনা হয় ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট; মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে হত্যা-নিপীড়নের মাধ্যমে জাতিগত নিধনের মুখে লাখো রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এই ঘটনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট বিশ্বের কাছে সাড়া ফেলে এবং এটি আন্তর্জাতিক সংকটে রূপ নেয়। কিন্তু বলা চলে এই সংকটকে একাই বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। রাখাইনে হত্যা-নিপীড়নের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। কিন্তু রোহিঙ্গাদের এই সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক শক্তি ও বিশ্বের মোড়লরা অনেকটা নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় ছিল।
বাংলাদেশ অবশ্য কূটনৈতিকভাবে এ সংকট মোকাবিলায় বিশ্ব দরবারে চেষ্টা-তদবির চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুটি ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবে প্রথম ভোটটি অনুষ্ঠিত হয় গত বছরের ১৮ নভেম্বরে। প্রথমবার যখন ভোটাভুটি হয়, তখন ১৩২টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে এবং ৯টি দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়। ৩১টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। পরবর্তীতে ৩১ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফা ভোটগ্রহণ হয়, তখন যে দেশগুলো আগে ভোটদানে বিরত ছিল, তাদের মধ্যে ৯টি দেশ এবার বাংলাদেশের বা রোহিঙ্গাদের পক্ষে ভোট দিয়েছে। চীন ও রাশিয়া বরাবর বিপক্ষে ভোট দেয়; তবে জাপান, ভারত ভোটাদানে বিরত থাকে।
বাংলাদেশে আসার পর থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বন্যা, ভূমিধ্বস, তীব্র ঝড়সহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে এবং এখন তারা কোভিড-১৯ মহামারীর রিরুদ্ধে লড়াই করছে। এর মধ্যে জানা গেছে গতকাল ১৪ জানুয়ারি টেকনাফ উপজেলায় এক রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। এভাবে ভিনদেশের শরণার্থী আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গারা মানবতার জীবনযাপন করছে। যা কোনো ভাবেই কাম্য নয়।
রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও আন্তর্জাতিক শক্তি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়ায় বলা যায় মিয়ানমার এক ধরনের স্বস্তির মধ্যেই আছে। মিয়ানমার সরকার দেশের ভেতরে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ওপর যে ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে, সে বিষয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পরও দেশটি কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বরং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে যে, রাখাইনে তারা বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তার জন্য সেখানে বিদেশি বিনিয়োগও আসছে। এর মূল কারণ হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের লক্ষ্যে এবং তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে যে পরিমাণ চাপ মিয়ানমারের ওপর দেওয়া উচিত ছিল, তা সেভাবে প্রয়োগ হয়নি।
মিয়ানমারের গাছাড়া অবস্থান থাকার কারণে তাদেরকে আন্তর্জাতিক চাপে রাখা এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গাদের যে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের ওপর গণহত্যা, জাতিগত নিধনের মতো অপরাধ মিয়ানমার সরকার সংঘটিত করেছে, তা আন্তর্জাতিক আদালত দ্বারাও প্রমাণিত। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে চীন ও ভারত বাংলাদেশকে নামমাত্র সান্ত্বনা দিলেও তাদের যে পলিসি, সেটা এখনও অনেকটাই মিয়ানমার সরকারের পক্ষে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিক তৎপরতা অনেক আগেই শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে চুক্তি করে মিয়ানমার সরকার। তবে, এই তিন বছরে একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। তাই রোহিঙ্গা সংকট একটা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিয়েছে এবং বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা একটা বড় ধরনের চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে আশ্রয় নেওয়া বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার কারণে আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি নিরাপত্তা ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় হাজারের মত মামলা হয়েছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, সংকট সমাধানে কার্জকর পদক্ষেপ না নিলে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও অনুধাবন করতে হবে।
এই অবস্থায় কিছুটা আশাবাদী বিষয় হচ্ছে, আগামী ১৯ জানুয়ারি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠক হতে যাচ্ছে ঢাকায়। এটিকে বিশ্লেষকরা এক ধরনের কূটনৈতিক অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন । এ আলোচনা সফল হলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আমরা আশার আলো দেখতে পাব। যদিও অতীতে এ রকম প্রয়াস থেকে কোনো সফলতা আসেনি, তারপরও আমরা আশাবাদী হতে চাই। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের শাসনামলে রোহিঙ্গা সংকটকে গুরুত্বহীন করে রেখেছিল। বাইডেন প্রশাসনকে ক্ষমতায় এসে সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটা শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। সর্বোপরি বিশ্ব শান্তির জন্য এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা জন্য রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক উদ্যোগ আরও শক্তিশালী করা উচিত।
এসডব্লিউ/এমআর/২৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ