এই মহাবিশ্বের ভেতরে থেকে আপনি আমি অর্থাৎ সবাই বুঝতে পারছি যে সময় বয়ে যাচ্ছে, শুধু ভবিষ্যতের দিকেই বয়ে যাচ্ছে। সময় কখনো পেছনের দিকে যায় না বলে আমাদের একধরনের দুঃখবোধও আছে!
কিন্তু আমরা যা দেখি, সব সময় সেটা ঠিক না-ও হতে পারে। আপনি কিন্তু অতীতও দেখতে পান, ভবিষ্যৎ নয়।
যেমন ধরুন, আপনি যে সূর্যটা দুপুর ১২টার সময় দেখছেন, ওটা কিন্তু ১২টার সূর্য নয়। ৮ মিনিটের বেশি আগের সূর্য। কারণ সূর্য থেকে আলো আসতে সময় লাগে ৮ মিনিট ৫২ সেকেন্ড। অর্থাৎ এক অর্থে সূর্যের অতীত রূপ দেখছি।
এখন অহরহ দেখা যায়, ২টি ব্ল্যাকহোল পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটা বড় ব্ল্যাকহোল তৈরি করছে। এগুলো কোটি কোটি বছর আগের ঘটনা। ধরা যাক, ১০ কোটি বছর আগে ঘটনাটা ঘটেছে। কিন্তু ব্ল্যাকহোল ২টি আমাদের থেকে ১০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। অর্থাৎ সেখান থেকে আলো আসতে সময় লাগে ১০ কোটি বছর।
তার মানে ১০ কোটি বছরের অতীত দেখছেন আপনি। সুতরাং বর্তমান বলে যেটা আমরা ভাবছি, সেটা আসলে পরম নয়। আপনি একটা হাঁচি দিলেন, আপনার বন্ধু ৫০ মিটার দূর থেকে দেখল, ৫০ মিটার পাড়ি দিতেও কিছুটা সময় ব্যয় হবে। আপনার বন্ধু ঠিক ততটুকু সময় পর আপনার হাঁচি দেওয়ার দৃশ্যটা দেখবেন।
এবার আপনি মহাবিশ্বের বাইরে চলে যান। বাইরে চলে যাওয়া মানে কিন্তু শুধু স্থানের বাইরে যাওয়া নয়, কালেরও বাইরে। মহাবিশ্বের বাইরের স্থানকাল ভেতরের স্থানকালের মতো হওয়ার সুযোগ নয়। তখন আপনার কাছে মহাবিশ্বটাকে একটা শঙ্কু আকৃতির অ্যাকুরিয়ামের মতো মনে হবে। তখন আপনি যে মহাবিশ্বটা দেখতে পাবেন, সেটা শুধু স্থানের মহাবিশ্ব নয়। স্থানকালের মিলিত মহাবিশ্ব।
যার শুরুটা হয়েছিল মহাবিস্ফোরণের পর থেকে। তাহলে শেষটা কোথায় দেখবেন। বর্তমানে যেখান থেকে মহাবিশ্ব থেকে বেরিয়েছিলেন, সেখান থেকে?
সম্ভবত না। কারণ, ঐ যে বললাম, স্থানের বাইরে যখন গেছেন সময়ের বাইরেও চলে যাবেন। স্থানকাল মিলিয়ে আপনার কাছে মহাবিশ্বটাকে একটা ফোলানো বেলুনের মতো মনে হবে। সেখানে আপনি ‘বর্তমান’কে একটা বিন্দু দিয়ে চিহ্নিত করতে পারেন। কিন্তু সেটা নিছকই একটা বিন্দুই মনে হবে।
আপনি বিন্দুটির বাম দিকটা অর্থাৎ অতীত যেমন দেখতে পারেন, ডান দিকটও হয়তো দখতে পাবেন। সেটা মহাবিশ্বে থাকা আপনার সর্বশেষ সময়, যেটাকে আপনি বর্তমান বিন্দু বলছেন তার জন্য ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎটাও আপনি দেখতে পাবেন। হয়তো মহাবিশ্বের শেষ পরিণতিটাও দেখে ফেলতে পারবেন।
মহাবিশ্বের বিগক্র্যাঞ্চ নামে একটা তত্ত্ব ছিল। ছিল বলছি এই কারণে, এখনকার অনেক কসমোলজিস্ট এই তত্ত্বকে বাতিল বলে রায় দিয়েছেন। হয়তো ওখানে গিয়ে দেখলেন, বিজ্ঞানীরা ভুল বলছেন, আসলে বিগক্র্যাঞ্চ হবে। তার মানে তখন মহাবিশ্বটা বেলুনের আরেক মাথার মতো দেখতে পাবেন।
যেখানে একটা বিন্দুতে শেষ হয়েছে মহাবিশ্ব। অথবা বিগক্র্যাঞ্চ যদি না-ও হয়, মহাবিশ্ব হয়তো ফানেলের মতো দেখেবেন। যেভাবেই দেখুন, শেষ পরিণতিটা দেখতে পাবেন। অর্থাৎ মহাবিশ্বের অতীত-বর্তমান ভবিষ্যৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হয়তো দেখে ফেলবেন। এটাকেই আসলে ব্লক ইউনিভার্স বলে।
ব্লক ইউনিভার্সের ধারণা, আলবার্ট আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা থেকে এসেছে। এই তত্ত্বে বলা হয়, অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বলে আলাদা কিছু নেই। স্থানের যেকোনো বিন্দুতে সময়ের এই ৩ রূপ একই সঙ্গে অবস্থান করে।
এই তত্ত্বে সময় স্থানের মতো আচরণ করে, মহাবিশ্বের যেকোনো বিন্দুতে, যেকোনো সময়, যেকোনো কিছু একই সঙ্গে অবস্থান করে। অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে। এদের মধ্যে ফিজিক্যাল কোনো পার্থক্য বা ব্যবধান থাকে না। এখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সমানভাবে বাস্তব। এটা কিভাবে সম্ভব?
ধরা যাক, একটা ব্লক বা একটা ঘন বস্তু। ইটের মতো, কিন্তু বিশাল বড়। এ ধরনের একটি ব্লকের ৪টি মাত্রা থাকে। এর মধ্যে ৩টি হলো স্থানের মাত্রা—দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা। চতুর্থ মাত্রাটি হলো সময়। চতুর্থ মাত্রার ছবিটা মনে মনে আঁকা কঠিন। এমনকি খাতায় বা গ্রাফিকসেও আঁকা যায় না অত সহজে।
তাই এক কাজ করা যেতে পারে। আমাদের ব্লক থেকে প্রস্থ আর উচ্চতার মাত্রাটা ঠিক রেখে দৈর্ঘ্যের মাত্রা পাল্টে নিতে পারি সময়ের সঙ্গে।
অর্থাৎ ব্লক বা বাক্সের দৈর্ঘ্য হলো সময়, যার শুরুটা হয়েছে বিগব্যাং থেকে। ব্লকের দৈর্ঘ্যের শেষ প্রান্তটা মহবিশ্বের শেষ সময়।
মহাবিশ্বের সব ঘটনা, যা কিছু অতীতে ঘটছে, বর্তমানে ঘটছে বা ভবিষ্যতে ঘটবে, সব কিছুই এই ব্লকের মধ্যেই থাকবে।
আপনি খুব সহজেই বলতে পারেন, এখন যা ঘটছে তা-ই-বর্তমান, আগামীকাল যা ঘটবে তা ভবিষ্যৎ, গতকাল যা ঘটেছিল তা অতীত। আবার আজকের দিনটা পেরিয়ে গেলে ‘আজকের দিনটাই’ অতীতে পরিণত হবে, ‘আগামীকাল’টাই বর্তমানে রূপ নেবে। আমাদের কাছে তাই মনে হয়, সময় বয়ে চলে।
কিন্তু ব্লক ইউনিভার্সে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব একসঙ্গে থাকে; তাই সময় বয়ে চলে এই কথাটা ব্লক ইউনিভার্সে খাটে না। অর্থাৎ ব্লক ইউনিভার্সে আসলে সময় প্রবাহিতই হয় না। মোদ্দাকথা হলো, ব্লক ইউনিভার্সে নির্দিষ্ট কোনো মুহূর্ত নেই। অর্থাৎ অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ—সবই আপেক্ষিক।
আবার স্থানের কথাই ধরুন, ‘এখানে’ বলতে আপনি কী বোঝেন? আপনি যেখানে অবস্থান করছেন সেই জায়গাটাই তো? কিন্তু আপনি আছেন চট্টগ্রামে, আমি আছি ঢাকায়। আপনার ‘এখানে’ আর আমার ‘এখানে’ এক নয়। আইনস্টাইন বলেছিলেন, যুগপৎ কোনো ঘটনা ঘটে না; যুগপত্তা বলে কিছুই নেই। একই সময়ে ঘটছে বলে মনে হলেও মধ্যবর্তী দূরত্বের ফারাক থাকার কারণে ঘটনাগুলো আসলে একই সঙ্গে ঘটছে না।
ব্লক ইউনিভার্সে ‘এখন’ আর ‘এখানে’ ঠিক একইভাবে কাজ করে, এদের মধ্যে আসলে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ স্থান আর কালের মধ্যে তফাত দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।
স্থানের মাত্রায় মাত্রার কথাই ধরুন, আপনি এখন যে স্থানে অবস্থান করছেন, এর পরের স্থানগুলোও রয়েছে। ধরা যাক, আপনি মেট্রো রেলে চড়ে মিরপুর থেকে মতিঝিল যাচ্ছেন। ধরা যাক, এই মুহূর্তে আপনি আগারগাঁও স্টেশনে অবস্থান করছেন। এরপরের স্টেশন ফার্মগেট, তারপর শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পল্টন এবং সবশেষে মতিঝিল স্টেশন।
আগারগাঁও স্টেশনে অবস্থান করলেও আপনি কিন্তু নিশ্চিত জানেন সামনে ফার্মগেট, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পল্টন এবং মতিঝিল স্টেশন রয়েছে। তেমনি আপনি পেছনে ফেলে এলেও শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, মিরপুর ১০, মিরপুর ১১ ও উত্তরা স্টেশন।
তাহলে সময়কে দৈর্ঘ্যের মতো একটা মাত্রা ধরলে বর্তমানের পাশাপাশি অতীত ও ভবিষ্যতের অস্তিত্বও এই মুহূর্তে রয়েছে।
এখন একটা প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। স্থানের মাত্রার হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, চাইলেই আপনি যেমন আগারগাঁও থেকে সামনে ফার্মগেট কিংবা শাগবাগের দিকে যেতে পারেন, তেমনি আগারগাঁও থেকে পেছন দিকে কাজীপাড়া, মিরপুর বা উত্তরার দিকেও ভ্রমণ করতে পারেন অনায়াশে। তাহলে কি সময়ের এই রেখা ধরে বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ ও অতীতেও ভ্রমণ করতে পারব?
ব্লক ইউনিভার্স তত্ত্ব বলছে, তাত্ত্বিক ও গাণিতিক, যৌক্তিক কোনোভাবেই সময় ভ্রমণে আপনার বাধা নেই।
আপনার মতামত জানানঃ