
একসময় মানুষের মন জয় করার জন্য ভেলকি দেখানো হতো, আবার কখনো তা ছিল ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির গভীরতম বহিঃপ্রকাশ। ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে সেই দুইটি দিকই যুগপৎভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আগুনের ওপর হাঁটা, কাঁচ খাওয়া, দেহে ধারালো বস্তু প্রবেশ করানো, এমনকি তরবারি গিলে ফেলা—এইসব ভয়ঙ্কর এবং অভাবনীয় কর্মগুলো অনেকের কাছে কেবল একধরনের ‘ম্যাজিক’ হলেও, অনেকের কাছে এটি হয়ে উঠেছে একেবারে ঈশ্বরিক সাধনার প্রতীক।
ভারতের মাদ্রাজে তোলা এক ঐতিহাসিক ছবিতে দেখা যায় এক জাদুকর তরবারি গিলে ফেলছেন। এটি সম্ভবত ১৮৭৩ সালের ভিয়েনা প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছিল। কিন্তু এই দক্ষতা বা অভিনয় কেবল বাহ্যিক রূপ নয়; এর পিছনে আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য এবং আধ্যাত্মিক অনুশীলন।
পল্লানিয়াম্মাল শানমুগম যখন তাঁর দ্বিতীয় সন্তানের গর্ভে ছিলেন, চিকিৎসক জানান, স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব নয়—সিজারিয়ান অপারেশনই একমাত্র পথ। কিন্তু তিনি মনে করেন, প্রাকৃতিক উপায়েই সন্তান জন্ম নেয়া তাদের জন্য নিরাপদ হবে। তাই তিনি হিন্দু দেবতা কার্তিকেয়র কাছে মানত করেন—যদি সুস্থভাবে সন্তান জন্ম হয়, তবে পাঙ্গুনি উথিরম উৎসবে নিজের শরীর দিয়ে ত্রিশূল বিদ্ধ করবেন কৃতজ্ঞতার প্রতীক হিসেবে। এই উৎসবে ভক্তরা শরীরে কাঁটা, শলাকা, লোহার রড ইত্যাদি ঢুকিয়ে নিজেদের অর্ঘ্য নিবেদন করেন।
তার পরের বছরেই, তিনি সত্যিই ত্রিশূল বিদ্ধ করেন নিজের পেটে। এখন পর্যন্ত তিনি এই কাজটি করেছেন ১৩ বার। “প্রতিবারই আমি যা চেয়েছি, তা পেয়েছি,” বললেন ৫০ বছর বয়সী শানমুগম। “ব্যথা লাগে না। ত্রিশূলটা যখন বের করে, তৎক্ষণাৎ একটু পবিত্র ভস্ম মাখালেই রক্ত বন্ধ হয়ে যায়। এক সপ্তাহের মধ্যেই গর্তগুলো আপনাতেই শুকিয়ে যায়।”
এই অদ্ভুত ও বিপজ্জনক কর্মকাণ্ডকে ‘জাদু’ ভাবা হলেও, অনেকেই একে দেখেন নিখাদ বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিক সাধনার ফল হিসেবে। আমেরিকান যাদুকর ডেভিড ব্লেইন তাঁর নতুন ডকুসিরিজ David Blaine: Do Not Attempt-এ এমন কৃত্য ও ধর্মের সংযোগ নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক প্রযোজিত এই সিরিজটি প্রচারিত হবে ২৩ মার্চ, এবং পরদিন Disney+ ও Hulu-তে স্ট্রিমিং হবে।
পাঙ্গুনি উথিরম ভারতের একমাত্র এমন উৎসব নয় যেখানে এমন চরম ভক্তির বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের গাজন উৎসবে চাষের ভালো ফলনের প্রার্থনায় পুরুষরা শরীরে লোহার রড, তীর এবং হুক বিদ্ধ করে। কেউ কেউ আগুনের উপর দিয়ে হাঁটে, কেউ পেরেকের বিছানায় শোয়। তামিলনাড়ুর থাইপূসাম উৎসবে আগুনের ওপর হেঁটে, জিহ্বা, গাল, এমনকি গায়ের বিভিন্ন অংশ বিদ্ধ করে সাধনা করেন ভক্তরা।
গরুড় থুক্কম নামের আরেকটি উৎসবে ভক্তরা নিজেদের পিঠে লোহার হুক গেঁথে মঞ্চের মতো উঁচু কাঠামো থেকে ঝুলে থাকেন। থিমথি উৎসবে, যা ভারত ছাড়াও ফিজি, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকায় পালিত হয়, ছোট শিশুরাও আগুনের খাদের উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে প্রমাণ করে তাদের ঈশ্বর-ভক্তি।
“এটা কোনো জাদু নয়—এটা বিশ্বাস,” বলেন ৩৯ বছর বয়সী ভক্ত রাম লক্ষ্মী তেওয়ার। “মানুষ শরীরে রড ঢোকায়, গাড়ি টানে পিঠে হুক গেঁথে। ঈশ্বর থাকলে কখনো কেউ আহত হয় না।”
ধর্ম ও জাদু ভারতে সহস্রাব্দ ধরে একে অপরকে প্রভাবিত করেছে বলে জানান অস্ট্রেলিয়ান ইতিহাসবিদ জন জুব্রঝিকি, যিনি Jadoowallahs, Jugglers and Jinns: A Magician History of India বইয়ের লেখক। তিনি বলেন, জিহ্বা কেটে আবার জোড়া লাগানো, মাটির নিচে জীবিত কবর হওয়া, আগুনের ওপর হাঁটা, বিচ্ছিন্ন অঙ্গ পুনরায় জোড়া লাগানো—এসব কৌশলের শিকড় পাওয়া যায় হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ এবং জৈন সন্ন্যাসীদের আসল ও পৌরাণিক সাধনায়।
তলোয়ার গেলা, উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় পুরোহিতদের চার হাজার বছরের পুরনো প্রথা। এটি একধরনের আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জনের উপায়, ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগের প্রতীক। এখন এটি একটি পারফর্মিং আর্ট হিসেবেও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
১৯৭০-এর দশকে ‘স্বামী মন্ত্র’ নামের একটি ম্যাগাজিন এমন ধর্মভিত্তিক জাদু শেখানোর ম্যানুয়াল প্রকাশ করে, যাতে ছিল ব্লেড গেলা, কাঁচের বাল্ব চিবানো, চোখ দিয়ে সূঁচ ঢুকিয়ে বের করার মতো ভয়ঙ্কর কৌশল।
জুব্রঝিকি বলেন, “ধর্ম ও জাদুর সম্পর্ক ভারতে ভেদের যুগ থেকেই চলে আসছে—খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১৭০০ সালের মধ্যে যখন ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদ রচিত হয়। অথর্ববেদে দেখা যায়, যাযাবর সাধুরা শ্বাস নিয়ন্ত্রণ, নৃত্য, অভিশাপ দেওয়া এবং ভূত তাড়ানোর মতো কাজ করতেন।”
জন জুব্রজিকি, বলেন ভারতীয় ধর্ম ও জাদুবিদ্যার মধ্যে সম্পর্ক কয়েক হাজার বছরের পুরনো। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ এবং জৈন সাধকদের মধ্যে যেসব “অলৌকিক” কার্যকলাপ ছিল—যেমন আগুনে হাঁটা, জিহ্বা কাটা এবং আবার জোড়া লাগানো—তা আজকের অনেক ম্যাজিকের ভিত্তি।
তরবারি গিলে ফেলার রীতি প্রায় ৪০০০ বছর আগের, যা প্রথম শুরু করেন ভারতীয় পুরোহিতরা। এটি তখন ছিল একধরনের আত্মিক সাধনা, যা ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের উপায় হিসেবে দেখা হতো। পরে এটি ছড়িয়ে পড়ে পারফর্মেন্স আর্ট হিসেবেও।
৭০-এর দশকে প্রকাশিত Swami ও Mantra নামক সাময়িকী এই ম্যাজিক ও ধর্মীয় সাধনাগুলোর আরও প্রসার ঘটায়। এই ম্যাগাজিনগুলোতে প্রকাশিত হতো কিভাবে মানুষ ব্লেড খায়, কাঁচের বাল্ব খায় কিংবা চোখ দিয়ে সূচ প্রবেশ করিয়ে অন্য চোখ দিয়ে বের করে—এইসব ‘ধর্মীয় ম্যাজিক’।
বৈদিক যুগ থেকেই ধর্ম ও জাদুবিদ্যার পারস্পরিক প্রভাব দেখা যায়। অথর্ববেদে উল্লেখ রয়েছে এক শ্রেণির সাধকদের, যারা একদিকে রোগ নিরাময় করতেন, অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর অভিশাপ দিতে পারতেন। বৌদ্ধ জাতক কাহিনিতেও দেখা যায় সাপ খেলিয়ে, তরবারি গিলে ফেলা এবং অন্যান্য অলৌকিক কর্মকাণ্ড।
মুঘল ও হিন্দু রাজসভাতেও জাদুকর, ভাঁড় ও ভেলকি দেখানো শিল্পীদের উপস্থিতি ছিল নিয়মিত। এরা শুধু রাজাদেরই বিনোদন দিতেন না, বরং ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিলেন।
আজকের যুগে, ধর্মীয় ম্যাজিশিয়ানরা পারফরম্যান্সের শুরুতে ইন্দ্রদেবকে স্মরণ করেন। দর্শক জানেন এটা একধরনের অভিনয়, তবে ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করাতে একধরনের আধ্যাত্মিক ভাবও জেগে ওঠে।
পল্লানিয়াম্মাল বলেন, “আমি ৯ বছর বয়সে প্রথম ত্রিশূল বিদ্ধ করি। শরীরের যেই অংশে সমস্যা থাকে, সেই অংশে ত্রিশূল প্রবেশ করানো হয়। আমি নিজ চোখে দেখেছি, মানুষ এইভাবে আরোগ্য লাভ করেছে, এমনকি আর্থিক সমস্যাও দূর হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, তাঁর আত্মীয়া একসময় নিজস্ব ঘর না থাকা এবং ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। মানত করেন, যদি ঈশ্বর তাঁর পরিবারকে সাহায্য করেন, তবে তিনি প্রতিবছর ত্রিশূল বিদ্ধ করবেন। আজ সেই ছেলেই একজন ইঞ্জিনিয়ার, এবং নিজে সাতটি ঘর তৈরি করেছেন। শানমুগাম বলেন, “এটা ম্যাজিক নয়, এটা ভক্তি।”
অবাক করা এই আচরণগুলো যতোই “স্টান্ট” বা “ট্রিক” মনে হোক, এগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে বিশ্বাসের এক অটুট শক্তি। আর সেটাই দেখাচ্ছে আজকের ভারত—যেখানে ধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অলৌকিকতার এক চিরন্তন মেলবন্ধন ঘটে চলেছে।
আপনার মতামত জানানঃ