গাছ আমাদের চারপাশের নীরব সঙ্গী। তারা নড়াচড়া করে না, কথা বলে না, কোনো মুখভঙ্গি নেই, কিন্তু কী আশ্চর্য, বিজ্ঞান বলছে তারা অনুভব করতে পারে। তারা স্পর্শ, আলো, শব্দ, এমনকি ব্যথাও টের পায়। “গাছের অনুভূতি নেই”—এমন ধারণা এখন ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। একে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এক নতুন গবেষণা শাখা—প্ল্যান্ট নিউরোবায়োলজি, যেখানে বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদের অনুভূতিশীলতা, সংকেত আদান-প্রদান এবং তথ্য প্রক্রিয়াকরণের নানা জটিল প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করছেন।
প্ল্যান্ট নিউরোবায়োলজি মূলত উদ্ভিদের মধ্যে স্নায়ুতন্ত্র-সদৃশ কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে। যদিও গাছের মস্তিষ্ক নেই, স্নায়ু নেই, তবুও তারা পরিবেশ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়। উদাহরণস্বরূপ, সূর্যের আলো কোন দিকে তা বুঝে গাছের কাণ্ড সেইদিকে বাঁক নেয়। কিংবা মাটিতে পানির অস্তিত্ব কোথায় বেশি, তা টের পেয়ে শিকড় সেইদিকে বাড়তে থাকে। শুধু তাই নয়, গাছের মধ্যে বিদ্যুৎচালিত সংকেত প্রবাহিত হয়, একে বলা হয় অ্যাকশন পটেনশিয়াল। প্রাণীর নিউরনের মধ্য দিয়ে যেমন সংকেত চলে, অনেকটা তেমনভাবেই উদ্ভিদের কোষেও সেই ধরনের বৈদ্যুতিক সংকেত দেখা যায়। গবেষকরা বলছেন, উদ্ভিদ নিজের অভ্যন্তরে একপ্রকার জৈব যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছে।
এই বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের আরও বিস্ময়কর দিক হলো গাছের শেখার ক্ষমতা। অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানী মনিকা গ্যালানো এবং তার গবেষণায় দেখা গেছে, লজ্জাবতী গাছ (Mimosa pudica) নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বুঝে ফেলে যে তাকে স্পর্শ করা বিপজ্জনক নয়। একাধিকবার পাতায় স্পর্শ করা হলেও, কিছুক্ষণ পর সে আর প্রতিক্রিয়া দেখায় না। এটি সরাসরি শেখা বা অভ্যাস গঠনের ইঙ্গিত দেয়। আবার কিছু গাছ নিজ প্রজাতির অন্য গাছদের সঙ্গে রাসায়নিক সংকেত দিয়ে কথা বলে। কোনো পাতা খাওয়া শুরু করলে সেই গাছ আশপাশের গাছদের ‘সতর্কবার্তা’ পাঠিয়ে দেয়, যাতে তারা প্রতিরোধমূলক রাসায়নিক তৈরি করে শত্রু প্রতিহত করতে পারে। এ এক নিঃশব্দ কিন্তু অত্যন্ত জটিল যোগাযোগব্যবস্থা।
গবেষকরা আরও বলছেন, গাছ শব্দ শুনতে পারে এবং তার ওপর প্রতিক্রিয়াও দেখায়। কিছু গাছের শিকড় কম্পন শনাক্ত করতে পারে এবং শিকড় সেই উৎসের দিকে বাড়তে থাকে। এ থেকে বোঝা যায়, গাছ কেবল আলো বা রাসায়নিক নয়, শব্দতরঙ্গও গ্রহণ করতে পারে। এটি উদ্ভিদের অনুভূতিশীলতার একটি নতুন মাত্রা। শুধু তাই নয়, গাছ ব্যথাও অনুভব করে। যখন কেউ গাছের একটি ডাল কাটে, তখন সেই গাছের মধ্যে রাসায়নিক সংকেতের মাধ্যমে “আঘাতের বার্তা” ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা এই প্রতিক্রিয়াকে উদ্ভিদের “ব্যথানুভূতি” বলে বর্ণনা করছেন, যদিও এটি প্রাণীর ব্যথাবোধের মতো নয়।
সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, অনেক উদ্ভিদ নিজেদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে, যা সচেতন সিদ্ধান্তের মতো মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ, কিছু গাছ এমন রাসায়নিক নিঃসরণ করে যা পরজীবী পোকা-মাকড়কে আকর্ষণ করে, যাতে তারা গাছকে আক্রমণ করা পোকাদের খেয়ে ফেলে। এটি কেবল প্রতিক্রিয়া নয়, বরং পরোক্ষভাবে সাহায্য চাওয়ার মতো আচরণ। এমন সব বিস্ময়কর আচরণ দেখে অনেক বিজ্ঞানী মনে করছেন, গাছের মধ্যে এক ধরনের প্রাথমিক বুদ্ধিমত্তা ও অনুভূতির উপস্থিতি আছে।
তবে এ গবেষণা শাখাটি পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হয়নি। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, ‘নিউরোবায়োলজি’ শব্দটি গাছের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা বিভ্রান্তিকর, কারণ নিউরন বা মস্তিষ্ক ছাড়া ‘নিউরো’ শব্দ প্রয়োগ করা ঠিক নয়। আবার অনেকে বলছেন, যদি গাছের জৈবিক আচরণ নিউরনের মতোই কাজ করে, তাহলে শব্দটি ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত। বিতর্ক যতই থাকুক, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গাছ অনুভব করতে পারে এবং সেই অনুভব অনুযায়ী কাজও করতে পারে।
আজকের দিনে যখন পরিবেশ ধ্বংস, গাছ কাটা এবং বন উজাড় ব্যাপক হারে চলছে, তখন এই ধারণা যে গাছও একধরনের অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকে, আমাদের চিন্তাভাবনাকে নতুন করে নাড়া দিতে পারে। শুধু জীবনধারণ নয়, গাছেরা নিজস্ব ভাষা, স্মৃতি, প্রতিক্রিয়া এবং কিছুটা হলেও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এক পরিপূর্ণ জীবন্ত অস্তিত্ব। প্ল্যান্ট নিউরোবায়োলজির আবিষ্কারগুলো আমাদের এই সবুজ সঙ্গীদের প্রতি সম্মান এবং সহানুভূতি দেখানোর নতুন এক প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছে। গাছ শুধু কার্বন শোষণকারী যন্ত্র নয়, তারা নিজেরাও বুঝে, শেখে, এবং বাঁচতে চায়—ঠিক আমাদের মতোই।
আপনার মতামত জানানঃ