যশোরের শার্শা উপজেলার ধান্যখোলা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সিপাহি মোহাম্মদ রইশুদ্দীন নিহত হয়েছেন। গতকাল সোমবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এরপর দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে বিজিবির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বিষয়টি জানানো হয়।
বিএসএফকে এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করতে দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি কূটনৈতিকভাবে বিএসএফের কাছে ‘তীব্র প্রতিবাদলিপি’ পাঠানো হয়েছে বলে বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বিজিবির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গতকাল ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে বিজিবি যশোর ব্যাটালিয়নের ধান্যখোলা বিওপির জেলেপাড়া পোস্টসংলগ্ন এলাকায় ভারত থেকে আসা একদল গরু চোরাকারবারিকে সীমান্ত অতিক্রম করে আসতে দেখে বিজিবির টহল দল।
এ সময় টহল দলের সদস্যরা তাদের ধাওয়া দিলে তারা দৌড়ে ভারতের দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বিজিবির টহল দলের সদস্য সিপাহি মোহাম্মদ রইশুদ্দীন চোরাকারবারিদের পেছনে ধাওয়া করতে করতে ঘন কুয়াশার কারণে দলছুট হয়ে পড়েন।
প্রাথমিকভাবে তাঁকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও পরবর্তী সময় জানা যায়, তিনি বিএসএফের গুলিতে আহত হয়ে ভারতের ভেতরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
বিজিবির যশোর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জামিল স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঘটনার পরপরই বিজিবি-বিএসএফের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ের পতাকা বৈঠক হয়।
বৈঠক থেকে জানা যায়, ভারতের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই সৈনিকের মৃত্যু হয়েছে। এ বিষয়ে বিএসএফকে সুষ্ঠু তদন্ত করার দাবি জানানোর পাশাপাশি কূটনৈতিকভাবে তীব্র প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে।
মোহাম্মদ রইশুদ্দীনের মৃতদেহ বাংলাদেশে দ্রুত ফেরত আনার বিষয়ে সব ধরনের যোগাযোগ অব্যাহত আছে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে প্রতি মাসেই ঘটছে হত্যাকাণ্ড। অধিকাংশ সময় যার শিকার বাংলাদেশি নাগরিকরা। সীমান্তে হত্যা বন্ধে আছে আন্তর্জাতিক আইন। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যেও নিয়মিত হয় আলোচনা। কিন্তু তবুও থামছে না সীমান্তে হত্যা।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে বিএসএফ সদস্যরা গুলি করে হত্যা করে ১৪ বছরের এক কিশোরীকে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি সেই ঘটনায় নিহত কিশোরীর নাম ফেলানী। লাল রঙের জামা গায়ে ফেলানীর লাশ কাঁটাতারের বেড়ায় পাখির মতো ঝুলে ছিল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। ৩০ ঘণ্টা পর বিজিবির কাছে ফেলানীর মরদেহ হস্তান্তর করেছিল বিএসএফ। ১২ বছর আগের সেই ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল দেশে-বিদেশে।
ফেলানী হত্যার পর এক যুগ কেটে গেলেও থামেনি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হত্যা। দেশটির সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে প্রতি মাসেই ঘটছে এমন হত্যাকাণ্ড। এটা এমনই এক হত্যা, যার দায় নেওয়ার মতো থাকে না কেউ।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত শুধু বিএসএফের সরাসরি গুলিতে নিহত হয়েছে ২২ বাংলাদেশি। আহত হয়েছে ২০ জনের বেশি। গুলি ছাড়াও এ সময়ে সীমান্তে ঘটেছে আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। বছর শেষে এই সংখ্যা যে আরও বৃদ্ধি পাবে, এ কথা বলাই বাহুল্য।
বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায়ও দেখা যায়, সীমান্তে হত্যা কখনোই থামেনি। বরং কোনো কোনো বছর এই সংখ্যা ছাড়িয়েছিল চল্লিশের ঘর। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২২ সালে বিএসএফের গুলি, নির্যাতন ও ধাওয়ায় ২৩ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। ২০২১ সালে বিএসএফের হাতে গুলিসহ বিভিন্নভাবে হত্যার শিকার হয়েছিল ২০ জন। ২০২০ সালে গুলি ও নির্যাতনে হত্যার ঘটনা ঘটে ৪৮টি। ২০১৯ সালে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে ৪৬ জন নিহত হয়। ২০১৮ সালে বিএসএফর গুলিতে নিহত হয় ৮ জন এবং নির্যাতনে নিহতের সংখ্যা ছিল ৬ জন। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৪ জন।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে, বিএসএফ আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করে। কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ‘ট্রিগার হ্যাপি’ নামে এক প্রতিবেদনে সীমান্তে গুলি থেকে বেঁচে যাওয়া এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ ছিল, বিএসএফ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা না করে বা সতর্ক না করেই নির্বিচারে গুলি চালায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী আত্মরক্ষার প্রয়োজনে প্রথমে সতর্ক করতে ফাঁকা গুলি ছুড়তে হবে। যদি এতে হামলাকারী নিবৃত না হয় এবং জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় সেক্ষেত্রে গুলি ছোড়া যাবে, তবে সেটা হতে হবে অবশ্যই হাঁটুর নিচের অংশে। কিন্তু এসবের কোনো তোয়াক্কাই যেন নেই বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। ফেলানী হত্যার দৃশ্যই কি মনে করিয়ে দেয় না, বিএসএফ গুলি ছোড়ে স্রেফ হত্যার উদ্দেশ্যেই। বিএসএফ কোনো ক্ষেত্রেই প্রমাণ করতে পারেনি যে, হতাহতের শিকার মানুষগুলোর মাধ্যমে তাদের প্রাণ সংশয় বা গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি ছিল।
সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার অন্যতম প্রধান কারণ দেশটির সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ। এ ছাড়াও দুই দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো ঘনবসতিপূর্ণ। এখানকার একশ্রেণির মানুষ কৃষি ও অন্যান্য পেশার পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত গবাদি পশু ও পণ্য পাচারের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। এই হত্যার শিকার অধিকাংশই বিভিন্ন চোরাচালান কর্মের সঙ্গে জড়িত বলেই অভিযোগ বিএসএফের। কিন্তু দুই দেশের আইন অনুযায়ী, কেউ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করলে, কাঁটাতার কাটলে বা পাচারের চেষ্টা করলে তাদের গ্রেপ্তার করে ওই দেশের আইনানুযায়ী বিচার করতে হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই গুলি ছোড়া বা নির্যাতন করা যাবে না।
ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তে মারণাস্ত্র বা লেথাল ওয়েপন ব্যবহার না করার কথা বলে আসছে। কিন্তু সীমান্তে বিএসএফের হাতে হত্যার শিকার ৯০ ভাগই গুলিতে নিহত হয়ে থাকেন। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও দেশটি দিয়েছে বারবার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই রাখছে না ভারত।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, সীমান্তে হত্যা প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। ভারত ভাগের পর সীমান্ত এলাকায় যারা বসবাস করেন, তাদের নিজেদের মধ্যেও কিছু বিষয় ভাগাভাগি হয়েছিল। কোনো কোনো পরিবারের রান্নাঘর এপারে, বসতভিটা ওপারে পড়েছে এমনও দেখতে পাই। দুটি দেশের মধ্যে এত বড় বর্ডার, এটা পাহারা দেওয়াও কিছুটা অসম্ভব বটে।
সীমান্তে হত্যা নিয়ে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কিছু কথা হয়েছিল। কেউ যদি দেশের সীমানা অবৈধভাবে পার হওয়ার চেষ্টা করে, ভারতের প্রতিনিধি জানতে চেয়েছিলেন, তখন আমাদের কী করণীয়। এদের ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ যদি নিতেই হয়, তখন বলা হয়েছিল দুই পক্ষই রাবার বুলেট ব্যবহার করবে। কোনো মারণাস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। যাতে করে হত্যাকাণ্ড কমানো যায়।
ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার কমানো খুবই মুশকিল বলে মনে করি। এটা যদি থামাতে হয়, তবে আমাদের কিছু মানবিক উপায় বের করতে হবে, যার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড ঘটবে না। হত্যাকাণ্ড আমরা সমর্থন করতে পারি না।
অন্যদিকে দুই পক্ষেরই সীমান্তে চোরাচালান থামানো প্রয়োজন। দুই দেশের মধ্যে সচিব পর্যায়ে যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে আমাদেরও মতামত দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। মারণাস্ত্র ব্যবহার না করার বিষয়ে আমরা বলেছিলাম। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি বিধায়, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। ফলে প্রতিনিয়তই এমন হত্যা দেখছি। যতদিন পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে সুষ্ঠু বাণিজ্য চুক্তি না হবে, যতদিন পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে আসা-যাওয়া সহজতর না হবে, ততদিন পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনাগুলো বোধহয় ঘটতেই থাকবে।
অন্যান্য দেশে এমনটা হয় না। কারণ দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে আসা-যাওয়া অনেক সহজ। তবে চোরাচালান বন্ধ হোক, এটা আমরাও চাই। এর জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ আমাদের চিন্তা করতে হবে, যার মাধ্যমে কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটবে না।
আপনার মতামত জানানঃ