জীবনের জন্য পানি সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান। এটি আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা খুব কম মানুষই জানি যে, পৃথিবীর মাত্র ১ ভাগ পানি মানুষ, অন্যান্য স্থলচর প্রাণী ও গাছপালার জন্য উপযোগী। বাকি পানি হয় সমুদ্রে না হয় দুই মেরুতে জমাট বাঁধা বরফে বন্দী। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সহজলভ্য ১ শতাংশ পানির বৈশ্বিক যে বিন্যাস তাতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। এতে জলবায়ু, কৃষিসহ অন্যান্য খাতে বিপদের আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।
নতুন এক গবেষণা থেকে দেখা গেছে, পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ তুলনামূলক দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। গবেষণা অনুসারে, ২০০১ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দক্ষিণ গোলার্ধ উত্তর গোলার্ধের চেয়ে বেশি দ্রুত শুকিয়েছে। বিজ্ঞানীরা এই অবস্থার কারণ হিসেবে জলবায়ু চক্র এল নিনোকে দায়ী করেছেন। সাধারণত কয়েক বছর পরপর পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের পানি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ উষ্ণ হয়ে উঠে।
বেষণাটি বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্সে প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বৃষ্টিপাত, নদী কিংবা অন্যান্য উৎস থেকে যে পরিমাণ পানি পাওয়া যায় এবং যে পরিমাণ পানি বাষ্পীভবন বা গাছের প্রস্বেদনের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে চলে যায় তার পার্থক্যের বিষয়টি আমলে নিয়েছেন। পাশাপাশি স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া চিত্র, নদী বা অন্যান্য স্রোতস্বতীর প্রবাহের পরিমাপ ইত্যাদি আমলে নিয়েই তাঁরা কাজ করেছেন।
দক্ষিণ গোলার্ধে পৃথিবীর স্থলভাগের মাত্র এক-চতুর্থাংশ অবস্থিত। কিন্তু গবেষণা বলছে, এই অঞ্চল শুকিয়ে যাওয়া বিশ্বের পরিবেশের পাশাপাশি অর্থনীতির ওপরও প্রভাব ফেলবে। গবেষণা অনুসারে, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার অধিকাংশ, অস্ট্রেলিয়ার মধ্য ও উত্তর-পূর্বাংশে পানির সহজলভ্যতা আগের চেয়ে অনেকটাই কমেছে। তবে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণাংশে অবশ্য এখনো পানির সহজলভ্যতা রয়েছে।
গবেষণা থেকে আরও দেখা গেছে, উত্তর গোলার্ধেও পানির সহজলভ্যতা কমছে তবে এখনো তা কমবেশি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এর কারণ হিসেবে গবেষকেরা বলেছেন, মানুষের প্রভাবের কারণেই এমনটা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে উন্নত সেচ ব্যবস্থা, বাঁধ ও খাদ্য উৎপাদনে উন্নত প্রযুক্তির কারণে এমনটা সম্ভব হয়েছে। তবে এসব প্রভাব দক্ষিণ গোলার্ধে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ভূপৃষ্ঠের মাত্র এক-চতুর্থাংশ এই গোলার্ধে হলেও বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষই এই অংশে বাস করে।
দক্ষিণ গোলার্ধ শুকিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো বৈশ্বিক বিপর্যয় নেমে আসা। কারণ বিশ্বের সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্ট আমাজন এই অঞ্চলে অবস্থিত। যা আবার বিশ্বের জলবায়ুর অন্যতম নিয়ন্ত্রক। এ ছাড়া বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের সবচেয়ে বড় আবাস এই অঞ্চলটি। এখানে রয়েছে বিশ্বের বিপুল পরিমাণ আদিবাসী জনগোষ্ঠী।
শুষ্ক হয়ে গেলে এই অঞ্চলে দাবানল, অগ্নিকাণ্ডের পরিমাণ বাড়বে। কৃষিজ উৎপাদন কমবে। তার চেয়েও বড় কথা হলো শুষ্ক হয়ে যাওয়ার কারণে বনভূমি এবং মাটিতে আবদ্ধ কয়েক বিলিয়ন টন কার্বন প্রকৃতিতে অবমুক্ত হবে। পরিবেশগত ও জনমিতিক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকা শুকিয়ে গেলে বিশ্ব বাজারে কৃষিপণ্যের সরবরাহে সংকট তৈরি হবে। কারণ দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো সয়াবিন, চিনি, মাংস, কফি ও অন্যান্য ফলফলাদির অন্যতম উৎপাদক।
আফ্রিকা শুকিয়ে গেলেও বিশ্বের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হাজির করবে। কারণ, এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি জলবায়ু জোন রয়েছে এবং এই অঞ্চলেরও আর্থসামাজিক ভূমিকা রয়েছে। সব মিলিয়ে এই অঞ্চল শুকিয়ে গেলে বিশ্বের খাদ্যশৃঙ্খলে টান পড়বে। খরার পরিমাণ বাড়ায় এই অঞ্চলে ক্ষুধা, দারিদ্র্যের হার বাড়বে।
আপনার মতামত জানানঃ