দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষ করে গত ২৮শে অক্টোবর বিএনপি’র মহাসমাবেশ ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার সরকারি ভাষ্য আন্তজার্তিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জরুরি নির্দেশনা পেয়ে এ সংক্রান্ত একাধিক প্রেজেন্টেশন পেপার (অডিও-ভিডিওসহ) প্রস্তুত করছে সেগুনবাগিচা। যা আজ অনুষ্ঠেয় কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে তুলে ধরা হবে।
সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র রাতে গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। জানিয়েছে, সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকাস্থ প্রায় অর্ধশত বিদেশি কূটনৈতিক মিশনের প্রধান (রাষ্ট্রদূত, হাই কমিশনার বা চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স), জাতিসংঘের অধীন ৭টি সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনের তিন জন প্রতিনিধিকে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ওই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত হতে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
মান্যবরদের উদ্দেশ্যে লেখা কমন আমন্ত্রণপত্রটি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবহৃত ইমেইল অ্যাড্রেসে পাঠানো হয়েছে। ‘গুড ইভিনিং’ দিয়ে শুরু হওয়া ওই আমন্ত্রণপত্রটি পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ের রাষ্ট্রাচার অনুবিভাগের প্রধানের (চীফ অফ প্রটোকল) নাঈম উদ্দিন আহমেদের দপ্তর থেকে।
তাতে দূতদের জানানো হয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন আমন্ত্রিতদের ব্রিফ করবেন। ব্রিফিংয়ে মন্ত্রী পরিষদের একাধিক সিনিয়র সদস্য এবং সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। দাওয়াতপত্রে আমন্ত্রিতদের ‘আন্তরিক উপস্থিতি’ কামনা করা ছাড়াও ফিরতি মেইল বা টেক্সট পাঠিয়ে ব্রিফিংয়ে থাকছেন কি-না তা জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
দাওয়াত কার্ড তৈরি থেকে শুরু করে ব্রিফিংয়ের সার্বিক প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত সরকারের একাধিক কর্মকর্তা রাতে ওই প্রতিবেদককে বলেন, আজকের ব্রিফিংয়ে কোন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ২৮শে অক্টোবর বিকেল থেকে বিএনপি’র বিরুদ্ধে অ্যাকশনে গেছে তা বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। বিএনপি মহাসচিবসহ অন্যদের গ্রেফতার নিয়ে বিদেশিদের সমুদয় জিজ্ঞাসার জবাব দেয়া হবে। মহাসমাবেশকে টার্গেট বিএনপি ঢাকাজুড়ে যে ‘তাণ্ডব’ চালিয়েছে সেটি সচিত্র নোট আকারে শেয়ার করার প্রস্তুতি রয়েছে।
এক কর্মকর্তা বলেন, একদিকে নির্বাচনকালীন ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধীরা মরিয়া হয়ে মাঠে, অন্যদিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন।
সেই সঙ্গে নানা ইস্যুতে বিদেশিদের চাপ আছে। সব মিলিয়ে তফসিল ঘোষণার আগে সম্ভবত এটাই হতে যাচ্ছে শেষ কূটনৈতিক ব্রিফিং। সঙ্গত কারণে সেখানে নির্বাচনকালে সরকারের ভূমিকা কী হবে তা তু্লে ধরা হতে পারে। বিশেষ করে সংবিধানের অধীনে থেকে বিশ্ববাসীর প্রত্যাশামাফিক একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতায় সরকারের যে অঙ্গীকার রয়েছে ব্রিফিংয়ে তা পূনর্ব্যক্ত করা হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ব্রিফিংটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে তাতে একটি বিষয় খোলাসা করা হবে। তা হলো- সংবিধান বহির্ভূত নিরপেক্ষ বা নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। তাছাড়া বিরোধীদের দাবিগুলোর পেছনে সুশীল সমাজ বা বিদেশি কেউ কেউ যেসব ‘যুক্তি’ তুলে ধরছেন তা-ও খণ্ডনের চেষ্টা করা হবে।
ব্রিফিংয়ে বিএনপি কর্মীদের আক্রমণের ধরণ, তাদের হাতে শতাধিক পুলিশ ও আনসার সদস্য কোথায়, কিভাবে হতাহত হয়েছেন তার ভিডিও ফুটেজ বা স্থিরচিত্র তুলে ধরা হবে। গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের কোথায়, কারা কিভাবে টার্গেট করেছে, প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলার বিস্তারিতও তু্লে ধরা হবে। অনেকটা বড় পরিসরে নতুন ভেন্যুতে আজকের কূটনৈতিক ব্রিফিংটি আয়োজন করা হয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, সরকার দলীয় একাধিক সংসদ সদস্য, আইন সচিব এবং বিভিন্ন মন্ত্রণায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ১০ই ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপি’র এমন মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে প্রায় তিনদিন অবরুদ্ধ ছিলো দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ গোটা নয়াপল্টন এলাকা। ৭ই ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া পুলিশি অ্যাকশনে তখনও বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সে সময় ঢাকার সব কূটনৈতিক মিশনে ঘটনার সরকারি ভাষ্য তু্লে ধরে চিঠি পাঠিয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ওই চিঠি পাঠানোর একটি ব্যখ্যা দিয়েছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি। প্রতিমন্ত্রীর দাবি ছিলো, “৭-১০ ডিসেম্বরের ঘটনা নিয়ে দূতাবাসগুলোতে গিয়ে সকাল-সন্ধ্যা বিএনপি ‘অপপ্রচার’ চালাচ্ছে, তাতে কূটনীতিকরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছেন। এটি দূর করতে মিশনগুলোতে চিঠি দেয়া হয়েছে।”
সেই চিঠিতে ৭ই ডিসেম্বর নয়াপল্টনে সংঘাত, গোলাপবাগ মাঠে বিএনপি’র সমাবেশের আগে দলটির মহাসচিব এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার বিষয়ক সরকারের বক্তব্য ছিল বলে জানানো হয়েছিলো। সেদিন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপি যে পরিমাণ বৈঠক করছে এবং তাদের সরবরাহ করা মিসইনফরমেশনে যেভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তাতে কেউ জিজ্ঞেসা করার আগেই আমাদের উচিৎ সত্যটা জানিয়ে দেয়া।
১০ই ডিসেম্বরের কর্মসূচি ঘিরে নাগরিকদের উদ্দেশ্যে নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকে দেশ। এবারও তারা তা করেছে। বিদেশিদের নিরাপত্তা সতর্কতা জারিতে নাখোশ ছিল সরকার। প্রতিমন্ত্রী সেদিন বলেছিলেন, দু’একটি রাষ্ট্র ট্রাভেল অ্যালার্ট দিয়েছে, কিন্তু ঢাকা শহরে তেমন কিছুই ঘটেনি। তারপরও আমরা বলেছি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে কোনো মূল্যে মানুষের জানমালের নিরাপত্তার দিবে, তারা দেশি-বিদেশি সকলের নিরাপত্তায় নিয়োজিত।”
দেখার বিষয় আজকের ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের আগাম নিরাপত্তা সতর্কতা এবং তাতে রাজনৈতিক কর্মসূচি মুহূর্তেই সহিংস রূপ নিতে পারে মর্মে যে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছিল তা নিয়ে সরকারের প্রতিনিধিরা কী বলেন?
আপনার মতামত জানানঃ