দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর নির্বিচার বোমা হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা। চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে একদিকে আরব দুনিয়ার প্রতিবাদ, অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ হলেও তাতে কান দিচ্ছে না নেতানিয়াহুর সরকার।
নানা সমালোচনা ও প্রতিবাদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এই বর্বরতা চালাচ্ছে ইসরাইলি প্রশাসন। রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে গাজা ভূখণ্ডে বোমা হামলার মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে ইসরাইল। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দাবি, গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ও ইসলামিক জিহাদকে নিশ্চিহ্ন করতেই তাদের এ অভিযান চলছে।
কিন্তু তার দাবির সঙ্গে গাজার বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কারণ চারদিকে শুধুই ধ্বংসযজ্ঞ আর বাতাসে লাশের গন্ধ। বিমান হামলায় নিহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশুসহ সাধারণ ফিলিস্তিনি
দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় ৪,৬৫১ ফিলিস্তিনির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
গত ৭ অক্টোবর গাজার হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে ১৪’র বেশি মানুষকে হত্যা করে। ইসরায়েল থেকে গাজায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ২১২ জনকে। ওই দিন থেকেই গাজায় তীব্র আকাশ হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। দেশটি কয়েকদিন ধরে গাজায় স্থল অভিযানের প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে।
গাজার পাশাপাশি লেবাননে হিজবুল্লাহর সঙ্গেও ইসরায়েলের সংঘাত বিস্তার লাভ করছে। সোমবার দিনের শুরুতে ইসরায়েলের বিমান লেবাননে দুইটি হিজবুল্লাহ সেলে আঘাত হানে। ওই দুটো সেল থেকে ইসরায়েলে ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেট হামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। হামলায় নিজেদের এজন যোদ্ধা নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে হিজবুল্লাহ। এ বিষয়ে আর কোনো তথ্য দেয়টি সশস্ত্র সংগঠনটি।
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ এখন পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যা ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি আরোপ করছে বলে সতর্ক করেছে ওয়াশিংটন। যে কারণে সেখানে ‘টার্মিনাল হাই অ্যালটিটিউড এরিয়া ডিফেন্স’ বা থাড প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন।
এছাড়াও পারস্য উপসাগর অঞ্চলে অতিরিক্ত ‘প্যাট্রিয়ট’ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও মোতায়েন করা হবে বলে পেন্টাগন জানিয়েছে। ওই অঞ্চলে মার্কিন সেনাদের ওপর সাম্প্রতিক হামলার জবাবে এসব ব্যবস্থা মোতায়েন করা হচ্ছে।
এদিকে, গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, গাজায় উপত্যকায় ৮টি শরণার্থী শিবিরের মধ্যে জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরটি বৃহত্তম এবং এখানকারই একটি আবাসিক ভবনে রোববার গভীর রাতে ইসরায়েলি বিমান হামলা চালায় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী।
গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি বোমায় বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষের নিচ থেকে ৩০টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে সেখানকার বেসামরিক প্রতিরক্ষা ইউনিট আল জাজিরাকে জানিয়েছে।
‘মরদেহ এত বেশি যে কাফনের কাপড়ও যথেষ্ট পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালে থাকা মরদেহগুলোর অবস্থা এতটাই খারাপ যে চেনা যায় না।’ কথাগুলো বলছিলেন ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার দেইর আল বালাহ এলাকার আল-আকসা হাসপাতালের একজন চিকিৎসাকর্মী।
বিদ্যুৎ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের তীব্র সংকটে থাকা গাজার অন্য হাসপাতালগুলোর চিত্রও একই। যেমন উত্তর গাজার আল–কুদস হাসপাতাল। হাসপাতালটির কাছের ভবনগুলো ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আহত ৫০০ জনের বেশি মানুষকে চিকিৎসা দিচ্ছেন হাসপাতালটির মাত্র ২৩ জন চিকিৎসক। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে কাকে আগে চিকিৎসা দেবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না তারা।
গাজা ছাপিয়ে এবার পশ্চিম তীরেও বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। গতকাল পশ্চিম তীরের জেনিন এলাকার একটি শরণার্থীশিবিরে এই হামলা চালানো হয়। এতে শিবিরের একটি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। নিহত হয়েছেন অন্তত একজন। অনেকে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি, মসজিদটির নিচে ভূগর্ভস্থ কক্ষে হামাসের একটি ঘাঁটি ছিল।
অবরুদ্ধ গাজায় বিদ্যুৎ, পানি, খাবার ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে চলছে হাহাকার। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শিশুদের মুখে একটু খাবার তুলে দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা। সেখানে রুটির দোকানের সামনে মানুষের লম্বা লাইন লেগে আছে। তবে সহজে রুটি পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, ময়দা ও বিদ্যুতের অভাব।
রুটির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইসরায়েলের নির্দেশে উত্তর গাজা থেকে খান ইউনিসে পালিয়ে আসা সালেহ এসকাফিও। তিনি বলেন, ‘আমরা চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছি। সেই ভোর থেকে রুটির জন্য অপেক্ষা করছি। শিশুরা অভুক্ত। পরিস্থিতি মর্মান্তিক।’
গতকালকের পাওয়া তথ্যে, গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলায় গাজায় নিহত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৬৫১ জনে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহতদের মধ্যে ১ হাজার ৮৭৩ জন শিশু। আহত হয়েছেন ১৪ হাজার ২৪৫ জনেরও বেশি।
আপনার মতামত জানানঃ