সুমিত রায়
২৩ শে আগস্ট, বুধবার, মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে যাওয়ার পথে আরএ-02795 লেজ নম্বরের একটি এমব্রায়ার লিগ্যাসি জেট মস্কোর ঠিক উত্তরে রাশিয়ার ত্ভারে (Tver) অঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, বিমানটিতে থাকা ১০ জনের সবাই নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে তিনজন ক্রু সদস্য এবং কুখ্যাত ওয়াগনার গ্রুপের নেতা ইভগেনি প্রিগোঝিন রয়েছেন। এই লেখাটিতে আমরা দেখতে যাচ্ছি সেদিন কী ঘটেছিল, প্রিগোঝিনের মৃত্যু পুতিনের শাসন সম্পর্কে আমাদের কী বলে এবং এটি ইউক্রেনের যুদ্ধ ও আফ্রিকায় ওয়াগনার উপস্থিতি উভয়কেই কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রিগোঝিনের মৃত্যুর আগের দিন রাশিয়ায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। সকালে, জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিনকে রাশিয়ান এরোস্পেস বাহিনীর কমান্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। গত অক্টোবরে ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্রে হার্ক ইভে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণ সহ রাশিয়ার বেশ কয়েকটি বিব্রতকর ব্যর্থতার পরে সুরোভিকিন (যাকে কখনও কখনও জেনারেল আর্মাগেডন নামে ডাকা হয়) রাশিয়ার আক্রমণ বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। এটা ঠিক যে, রাশিয়ান সেনাবাহিনী সুরোভিকিনের পূর্বসূরীদের তুলনায় সুরোভিকিনের কমান্ডের অধীনেই নিঃসন্দেহে বেশি ভাল যুদ্ধ করেছে, কেননা তার অধীনেই রুশ বাহিনী ইউক্রেনীয় অবকাঠামোকে বেশি আক্রমণাত্মকভাবে টার্গেট করেছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল এখানেই যে, তিনি তুলনামূলকভাবে ওয়াগনার গ্রুপ এবং প্রিগোঝিনদের কাছাকাছি ছিলেন। কয়েক মাস আগে ওয়াগনার অভ্যুত্থানের চেষ্টা করার পরে, তিনি মূলত নিখোঁজ হয়ে যান এবং ক্রেমলিন তার অবস্থান সম্পর্কে কোনও তথ্য সরবরাহ করতে অস্বীকার করে। তবে অতীতের দিকে তাকালে মনে হয় তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল, এবং ক্রেমলিন স্পষ্টতই এখন তাকে সরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্পষ্টতই সুরোভিকিনকে সরিয়ে দেয়াটাই একটা বিশাল খবর ছিল, আর একভাবে, এটি ইউক্রেনের জন্য ভাল খবরই। কেননা সুরোভিকিন যুক্তিযুক্তভাবে ইউক্রেনে রাশিয়ার সবচেয়ে দক্ষ সিনিয়র কমান্ডার ছিলেন এবং তিনি যুদ্ধে কী ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছিলেন তা কখনোই স্পষ্ট ছিলোনা।
কিন্তু এর কয়েক ঘন্টা পরেই আরও বড় কিছু ঘটে যায় : ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের জেট মস্কোর ঠিক উত্তরে বিধ্বস্ত হয়েছিল। জাহাজে কেবল প্রিগোঝিনই ছিলেন না, ওয়াগনারের মূল প্রতিষ্ঠাতা দিমিত্রি উটকিনও ছিলেন।উল্লেখ্য, উটকিন একজন নব্য-নাৎসি ছিলেন যিনি ২০১৩ সাল পর্যন্ত রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থার একটি শাখা জিআরইউতে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, আর তখনই তিনি প্রিগোঝিনদের সাথে ওয়াগনার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এই খবরের প্রতিক্রিয়ায় সেন্ট পিটার্সবার্গে ওয়াগনার সদর দপ্তরে প্রিগোঝিনের সম্মানার্থে একটি ক্রুসিফিকস প্রজ্জ্বলিত করা হয়। ওয়াগনার এয়ারলাইন্সের টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে প্রিগোঝিন সম্প্রতি আফ্রিকা থেকে ফিরে এসেছেন (যেখানে ওয়াগনার গ্রুপের বেশিরভাগ সদস্য বর্তমানে মোতায়েন রয়েছে)। প্রিগোঝিন মাত্র কয়েক দিন আগে আফ্রিকা থেকে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন। তখন মনে হচ্ছিল যে তিনি তার অপারেশনের ফোকাস আফ্রিকার দিকে সরিয়ে নিচ্ছেন, সেইসাথে তিনি তার শেষ বার্তায় একটি টেলিফোন নম্বর প্রকাশ করেছিলেন যা দেখায় যে রাশিয়ায় ওয়াগনারের জন্য নতুন নিয়োগ চলছে।
সুতরাং, যদি ধরে নেওয়া হয় যে এটি কোনও দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা ছিল না, তাহলে এখানে কী ঘটেছিল? স্পষ্টতই সকলের ঐকমত্য হল এই যে, এটা পুতিনেরই কাজ। তবে বর্তমানে রাশিয়ার টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোতে আরও দুটি আধা-ষড়যন্ত্র তত্ত্ব চলছে। প্রথমটি হ’ল এই সমস্ত কিছু প্রিগোঝিন এবং পুতিন মিলেই মঞ্চস্থ করেছে, এবং আদতে প্রিগোঝিন মারা যাননি। কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে প্রথম বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার প্রায় আধা ঘন্টা পরে, প্রিগোঝিনের মালিকানাধীন আরেকটি বিমান অন্য দিকে, অর্থাৎ সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে মস্কোর দিকে উড্ডয়ন করেছিল এবং নিরাপদে অবতরণ করেছিল।
রাশিয়ান টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলিতে আরও গুজব রয়েছে যে প্রিগোঝিনকে পুতিন নয় বরং জিআরইউ (GRU বা চিফ ইন্টেলিজেন্স অফিস) হত্যা করেছে, কারণ প্রিগোঝিন আফ্রিকায় ওয়াগনারকে প্রতিস্থাপন নিয়ে জিআরইউ এর পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন। তবুও, সর্বাধিক সম্ভাব্য ব্যাখ্যাটি মনে হয় এই যে, প্রিগোঝিনকে পুতিনই হত্যা করেছিলেন। প্রিগোঝিন যে কোনওভাবে এখনও বেঁচে আছে এই ধারণাটি গভীরভাবে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম দাবি করেছে যে তারা ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রিগোঝিন এবং উটকিনের মৃতদেহ সনাক্ত করেছে এবং যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তবে, প্রিগোঝিন যে রকম সাহসী, নিশ্চয়ই তিনি টেলিগ্রাম বা অন্য কিছুতে এতদিনে একটি ভিডিও প্রকাশ করে ফেলতেন।
একইভাবে, এ বছরের শুরুতে অভ্যুত্থান চেষ্টার পর পুতিন সুস্পষ্টভাবেই প্রিগোঝিনকে সরিয়ে ফেলতে চাইবেন। যদিও আপনার মনে হয়ে থাকে যে, পুতিনের প্রিগোঝিনকে মারতে অনেক দেরি হলো, সেক্ষেত্রে আপনাকে বুঝতে হবে যে এটা পুতিনের প্যাটার্নের বাইরের কিছু না। আপনি আলেকজান্ডার লিতভিনেঙ্কো এবং আনা পলিটকোভস্কায়ার উদাহরণের কথাই ধরুন। এরা চেচেন যুদ্ধের সমালোচক করেছিল ২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকে, আর এদেরকে হত্যা করা হয়েছিল এর কয়েক বছর পরে ২০০৬ সালে। এমন শক্তিশালী প্রমাণও রয়েছে যা অনুসারে, বিমানটি কেবল বিধ্বস্তই হয়নি, একে প্রজেক্টাইল ছুড়ে ভূপাতিত করা হয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী এবং ওয়াগনার-সমর্থিত গ্রে জোন চ্যানেল জানিয়েছে যে দুর্ঘটনার আগে দুটি বিস্ফোরণ হয়েছিল, সম্ভবত অ্যান্টি-এয়ার সিস্টেম থেকে নিক্ষিপ্ত প্রজেক্টাইলের কারণেই বিস্ফোরণ ঘটে, যা অবশ্যই সেই এন্টি-এয়ার মিসাইলগুলো থেকে হয়ে থাকবে। সোহায়েল মিডিয়ায় সেই ক্র্যাশের ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে আপনি দেখতে পারবেন, হঠাৎ করে বিমান আকাশ থেকে ফল করছে, এবং মনে হচ্ছে সেখান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে, যা নির্দেশ করে এটা সাধারণ ক্র্যাশিং ছিলোনা, বরং এটাকে আঘাত করা হয়েছিল।
তো, বর্তমানে যে মতটাকে কনসেন্সাস বা সর্বসাধারণের মত বলে মনে হচ্ছে সেটা যদি হয়ে থাকে, অর্থাৎ পুতিনই যদি প্রিগোঝিনকে হত্যা করে থাকেন, তাহলে এর অর্থ কী দাঁড়ায়? মানে এর পর কী হতে যাচ্ছে? ওয়েল, পুতিনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপই বটে। ওয়াগনার-অনুমোদিত টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলি ইতিমধ্যে তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে এবং বেলারুশের মিডিয়া জানিয়েছে যে বেলারুশে ওয়াগনার সৈন্যরা সম্ভবত ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে আরেকটি বিদ্রোহ করার জন্য রাশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছে। তবে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে পুতিন নিরাপদে আছেন। বেলারুশের কর্তৃপক্ষ বেলারুশের টেইল ভিলেজের প্রধান ওয়াগনার গ্রুপ ক্যাম্পের এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে এবং এখনও ওয়াগনার থেকে যথেষ্ট সাড়া পাওয়া যায়নি। বিশিষ্ট সূত্রগুলি ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে যে রাশিয়ান সেনাবাহিনী বেলারুশের অবশিষ্ট ওয়াগনার সৈন্যদের রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে অঙ্গীভূত করার পরিকল্পনা করছে।
পুতিন যদি এই তাৎক্ষণিক ঝুঁকিগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তবে এটি সম্ভবত ব্যক্তিগতভাবে তার পক্ষে ভালই হবে। আফটার অল, এর মাধ্যমে তিনি প্রিগোঝিনকে সরিয়ে দিচ্ছেন এবং, এবং অন্যান্য অভিজাতদের কাছে এটি স্পষ্ট করে দিচ্ছেন যে, তাকে তার ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার চেষ্টার পরিণতি কী হতে পারে। তবে ইউক্রেনে রুশ সেনাবাহিনীর জন্য এটি খুব একটা ভালো খবর নয়। এই মুহুর্তে রাশিয়ার অভিজাতদের মধ্যে মূলত কোনও আস্থা থাকছে না, যার অর্থ পুতিনকে ইউক্রেনের যুদ্ধের বিচারের জন্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুসহ তার সহকর্মীদের উপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক ইতিহাস যদি কিছু প্রমাণ করে থাকে, তবে তা হলো পুতিনের অভ্যন্তরীণ বৃত্ত আসলে যুদ্ধ লড়তে খুব একটা ভালো নয়, এ কারণেই তাকে ওয়াগনারকে প্রায়োরিটাইজ করতে হয়েছিল।
আফ্রিকার সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের জন্যও এটি খুব একটা ভালো খবর নয়। রাশিয়া ওয়াগনার গ্রুপের মাধ্যমে কিছু আফ্রিকান দেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, যা সিকিউরিটি গ্যারান্টার হিসাবে কাজ করেছে। উটকিন এবং প্রিগোঝিন মারা যাওয়ার সাথে সাথে ওয়াগনার আফ্রিকায় এর কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াটা অবশ্যই কঠিন হবে এবং এটি সেই দেশগুলির পক্ষে ভাল হবে না যারা নিরাপত্তার জন্য ওয়াগনারের উপর নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, মালির কথাই ধরুন, যা এক বছর আগে ওয়াগনারকে দিয়ে ফরাসিদেরকে প্রতিস্থাপিত করেছিল।
ওয়াগনার সেনাবাহিনী বর্তমানে তিনটি ফ্রন্টে লড়াই করছে: আল-কায়েদার একটি শাখার বিরুদ্ধে যা বর্তমানে টিম্বুকটুকে ঘিরে রেখেছে, আইএসআইএস যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যারা পুরো সাহেলকে অস্থিতিশীল করছে এবং এখন উত্তরে আরব তুয়ারেগ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে। ওয়াগনার ছাড়া, মালির পক্ষে এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন, এবং এটি সাহেল অঞ্চলের বৃহত্তর নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। তো এবারে আফ্রিকার দিকে একটু নজর রাখতে হবে, সেখানকার রাজনৈতিক পটের পরিবর্তন আসতে চলেছে…
আপনার মতামত জানানঃ