ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হোয়াইট হাউসের লাল গালিচায় পা দেয়ার আগেই ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেছিলেন, গণতন্ত্র প্রচারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টার বিপরীতে নয়াদিল্লি যেন প্রতিবেশী দেশগুলোতে নিজের স্বার্থ সুরক্ষার ওপর বেশি জোর দেয়।
বিশেষ করে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তারা যুক্তি দিয়েছিল যে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে ঘোষিত ভিসা নীতির প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখাই ভারতের জন্য সবচেয়ে লাভজনক।
মোদির সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ‘পারস্পরিক স্বার্থের ইস্যুতে’ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যেকার সহযোগিতাকে তুলে ধরা। তবে অনেকেই প্রত্যাশা করেছিল যে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গও স্থান পাবে। যদিও মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের পর প্রেস রিপোর্টগুলো বাংলাদেশের বিষয়ে লক্ষণীয়ভাবে নীরব ছিল।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্র-ভারত যৌথ বিবৃতিতেও বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করা হয়নি। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থকদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। কারণ, তারা আশা করেছিল যে, শেখ হাসিনার পক্ষ নিয়ে বাইডেনের সঙ্গে কথা বলবেন মোদি।
এমন প্রেক্ষাপটে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের একটি বড় অংশের মনের কথা বলার জন্য শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো যেভাবে বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে তাকে ‘নব্য উপনিবেশবাদের রপ্তানি’ এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘স্পষ্ট হস্তক্ষেপ’ করার শামিল বলে উদ্বেগ জানিয়েছে রাশিয়া। ইরানের রাষ্ট্র-সমর্থিত টেলিভিশনেও মস্কো এবং বেইজিং থেকে আসা অভিযোগের প্রতিধ্বনি শোনা গেছে।
এদিকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং অবাধ নির্বাচনের গুরুত্বের উপর মার্কিন চাপের প্রতিফলন দেখা গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেও। তারাও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিষয়গুলোকে বাংলাদেশের বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
যদিও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সত্ত্বেও আরও পাঁচ বছর ক্ষমতা নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ নিয়ে ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আসন্ন নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতার উপরই নির্ভর করবে।
সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনগুলোতে ভারত শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পাশেই ছিল। তবে নরেন্দ্র মোদির সর্বশেষ ওয়াশিংটন সফরের সময় মোদির এই নীরবতা কি এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, দিল্লি আস্তে আস্তে আওয়ামী লীগ সরকারকে নিয়ে তার অবস্থান পরিবর্তন করছে?
আরও প্রশ্ন উঠেছে, বাইডেন প্রশাসনের কাছে আওয়ামী লীগের পক্ষে ওকালতি করার জন্য ভারত তার নিজের রাজনৈতিক পুঁজি ব্যয় করবে কিনা।
আরও বিস্তৃতভাবে, মার্কিন-ভারত অংশীদারিত্ব এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উন্নয়নকে কতোটা প্রভাবিত করবে সে বিষয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।
ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অফ পিস-এর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র উপদেষ্টা ড্যানিয়েল মার্কি তার সাম্প্রতিক পররাষ্ট্র বিষয়ক নিবন্ধে বলেন, ওয়াশিংটন ও দিল্লির মধ্যে স্বার্থের মিল রয়েছে কিন্তু মূল্যবোধের নয়।
তিনি যোগ করেছেন যে, মার্কিন কর্মকর্তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে, ভারত তাদের মিত্র নয়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক বরখা দত্ত ওয়াশিংটন পোস্টে লিখেছেন, ভারত চীনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তার পরামর্শ নেবে না। নয়াদিল্লি তার নিজের শর্তে সম্পর্ক পরিচালনা করতে চায়। কৌশলগতভাবে সহযোগিতাকে তারা দীর্ঘমেয়াদি মিত্রতা হিসেবে দেখতে চায় না।
এই দু’টি নিবন্ধই প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরের প্রাক্কালে প্রকাশিত হয়েছিল। এতে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল যে, সফরের আড়ম্বরের নিচে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বিষয়বস্তু চাপা পড়বে না। সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্ককে বর্ণনা করতে ‘এআই’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
সম্ভবত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মিল রেখে আমেরিকার ‘এ’ ও ইন্ডিয়ার ‘আই’ নিয়ে শব্দটি তৈরি করেছেন তিনি। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের একটি সাধারণ দিক রয়েছে। এখনো এআই ও যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের কিছু অজানা বিষয় রয়েছে যা সংজ্ঞায়িত করা হয়নি।
বাংলাদেশ কি এখন সেই অজানা অংশের মধ্যে রয়েছে? যুক্তরাষ্ট্র এখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে চাপ দিচ্ছে এবং ভারত এখনো এর প্রভাবের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
মোদির সফরের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ কীভাবে উঠবে জানতে চাইলে এনএসসি কো-অর্ডিনেটর জন কিরবি বলেছিলেন, আমরা ভারত সরকারকে বাংলাদেশের সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কথা বলতে দিয়েছি।
কিন্তু আমরা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে আমাদের আকাক্সক্ষাও ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করেছি। মোদি সরকারের সাফল্য উদ্যাপনের জন্য দিল্লিতে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রাহ্মনিয়াম জয়শঙ্কর সম্প্রতি বলেন যে, ভারত তার প্রতিবেশীদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে ক্রমশ কম হস্তক্ষেপ করছে। প্রধানমন্ত্রী মোদির ওয়াশিংটন সফরের মাত্র এক সপ্তাহ পরই এই মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং নতুন ভিসা নীতি প্রয়োগ করা ছাড়া শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকাল ছিল চ্যালেঞ্জহীন। তবে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে যে, ওয়াশিংটন আর বাংলাদেশের প্রতি নীতির বিষয়ে নয়াদিল্লিকে অনুসরণ করবে না।
ওয়াশিংটনের সাম্প্রতিক দৃঢ় অবস্থান এবং মোদি সফরে বাংলাদেশ নিয়ে নীরবতা এই ধারণাকে আরও জোরালো করেছে। এই আবহেই সম্প্রতি ঢাকা সফর করেন ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে ভারতীয় কর্মকর্তারা ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর যেভাবে ঘনঘন বাংলাদেশ সফর করতেন, তা এখন কমে আসছে। বাংলাদেশ নিয়ে মোদি-বাইডেন বৈঠকে আলোচনা হয়েছিল কিনা তা নিয়ে যেহেতু কিছুই জানা যায়নি, তাই পর্যবেক্ষকরা সামনেও এই সফর নিয়ে বিশ্লেষণ অব্যাহত রাখবেন। সূত্র: যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাউথ এশিয়া পার্সপেক্টিভস (SAP)
এসডব্লিউএসএস১০০৫
আপনার মতামত জানানঃ