দেশের কৃষিতে সবচেয়ে বড় প্রকল্পের কাজে হাত দিয়েছে সরকার। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই দেখা দিয়েছে অনিয়ম। যা কিনা প্রকল্পের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বিশ্বব্যাংকের দেয়া শর্তের সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে এই অনিয়ম থেকে সৃষ্টি হতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়। মুখ থুবড়ে পড়তে পারে গোটা প্রকল্প।
কৃষিখাতে সর্বকালের সর্ববৃহৎ এ প্রকল্পের নাম সংক্ষেপে পার্টনার। প্রোগ্রাম অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন এন্টারপ্রেনরশিপ অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স (পার্টনার)। গত ১৮ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সাত হাজার ২১৪ কোটি টাকার এই প্রকল্প অনুমোদন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রকল্প অনুমোদনের এক মাসের মাথায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রকল্প পরিচালকসহ অন্যান্য বড় কর্তাদের। আর এখানেই ধরা পড়েছে অনিয়ম। প্রকল্প পরিচালক (প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান। কিন্তু তার নিয়োগ নিয়মানুগ উপায়ে ঘটেনি।
২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জারিকৃত উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত নিয়মাবলিতে বলা রয়েছে, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে আট সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটির মাধ্যমে বাছাই করে প্রকল্প পরিচালক নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে এমন কোন কমিটি গঠন করা হয়নি। নিয়োগ হয়েছে পছন্দের ভিত্তিতে।
মন্ত্রণালয় জারিকৃত ওই পরিপত্রের ৩.২(খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের ক্ষেত্রে উক্ত নির্বাচক কমিটি প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের মানদণ্ড হিসেবে শিক্ষাগত যোগ্যতা, কর্ম অভিজ্ঞতা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা, প্রকিউরমেন্ট সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ বিবেচনা করবে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা ও প্রকিউরমেন্ট সংক্রান্ত যোগ্যতার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটেছে।
একই পরিপত্রের ৩.২(ঙ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বাছাইকৃত ব্যক্তির প্রকল্প মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস পর্যন্ত চাকুরীর মেয়াদ থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু নিয়োগকৃত কর্মকর্তার চাকুরির মেয়াদ মাত্র দুই বছর রয়েছে। এই প্রকল্পের মেয়াদ বিবেচনায় নিলে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫ বছর ৬ মাস চাকুরির মেয়াদ থাকা আবশ্যক। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মেয়াদ শেষ হলে প্রকল্পটি সমস্যায় পড়বে। অথচ পরিপত্রের বিধি মেনে নিয়োগ দিলে এই সংকট এড়ানো যেত।
পরিপত্রের ৪.৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ক্রয় সংক্রান্ত বিধানাবলী ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং প্রকল্প প্রণয়ন, পক্রিয়াকরণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে পরিচালকের পদে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অথচ পুরোপুরিভাবে এসব শর্ত উপেক্ষা করে মিজানুর রহমানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সরকারি বিধি অনুযায়ী এরকম ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের অন্যতম শর্ত হলো, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট কোন প্রকল্প বাস্তবায়নের সাত বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। কিন্তু এ বিধির ব্যত্য় ঘটিয়েই মিজানুর রহমানকে গায়ের জোরে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের পূর্বতন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য এর পরিচালকের সিজন লং, আইসিএম, আইপিএম ট্রেনিং থাকা বাধ্যতামূলক হলেও মিজানুর রহমানের তেমন কোন প্রশিক্ষণ নেই। এতে করে প্রকল্পটির অন্যতম উদ্দেশ্য ৩ লাখ হেক্টর জমিতে গ্যাপ প্রটোকল বাস্তবায়নের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন ও বিদেশে রপ্তানি কার্যকম ব্যাহত হওয়ার সমূহ শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির অর্থায়ন ফলাফলভিত্তিক। অর্থাৎ এটি ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন হবে। এক ধাপের কাঙ্ক্ষিত ফল এলেই অন্য ধাপের জন্য অর্থ মঞ্জুর করবে দাতা সংস্থা। যদি প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না আসে, তাহলে ঋণ চুক্তি অনুযায়ী পরবর্তী বছরগুলোর বরাদ্দ পাওয়া যাবে না। কিন্তু প্রকল্প পরিচালকের এ ধরনের প্রকল্পের পূর্বে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকায় এটি প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়ক হবে না এবং তার নিয়োগ গোটা প্রকল্পকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।
এছাড়া বিশ্ব ব্যাংক-এর অর্থনৈতিক চুক্তি অনুযায়ী, প্রথম বছরে অর্থায়নের পর কাঙ্ক্ষিত ডিজবার্সমেন্ট লিংক ইন্ডিকেটরের ফলাফল লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক অর্জন করতে না পারলে প্রথম বছরের বিনিয়োগকৃত অর্থও বিশ্ব ব্যাংক ফেরত চাইতে পারবে। প্রকল্প পরিচালকের অদক্ষতার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটোলে তা দেশের জন্য লজ্জাজনক ও পরবর্তী অনেক প্রকল্পে সংকট সৃষ্টি করবে।
সূত্র জানায়, দেশের ৬৪ জেলার ৪৯৫ উপজেলায় পার্টনার প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে চলতি জুলাই মাস থেকে। প্রকল্পের মেয়াদ সম্পন্ন হবে ২০২৮ সালের জুন মাসের শেষে। প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে সাত হাজার ২১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন এক হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা ও প্রকল্প সাহায্য হিসেবে আসবে পাঁচ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা।
প্রকল্প সাহায্য হিসেবে বিশ্ব ব্যাংক দেবে পাঁচ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ও আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ) দেবে ৫০০ কোটি টাকা। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হল, বিদ্যমান কৃষি ব্যবস্থাকে রূপান্তর করে বাণিজ্যিক কৃষিতে পরিবর্তন এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য এনে কৃষি পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা।
এই মেগাপ্রজেক্টের মাধ্যমে তিন ফল ও সবজি আবাদী জমি বৃদ্ধি, জলবায়ু অভিঘাত সহনশীল উচ্চফলনশীল নতুন ধান ও দানাদার ফসলের জাত উদ্ভাবন, উন্নত ও দক্ষ সেচ প্রযুক্তি ব্যবহার, দেশব্যাপী দুই কোটি ২৭ লাখের অধিক কৃষক পরিবারকে ‘কৃষক স্মার্ট কার্ড’ বিতরণ, তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, কৃষি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই গলদ দেখা দেয়ায় এখন এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। নিয়ম ভঙ্গ করে অদক্ষ কর্ককর্তাকে পদায়নের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা প্রকল্পের শুরুতেই যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, তা কৃষি খাতের এই মেগা প্রজেক্টের মাধ্যমে আদৌ কিছু অর্জন করা যাবে কিনা, সেই প্রশ্নকেই সামনে নিয়ে এসেছে।
আপনার মতামত জানানঃ