ভারত থেকে করোনার ভ্যাকসিন আমদানি করার কথা থাকলেও এতে দেখা দিয়েছে নতুন জটিলতা। ভ্যাকসিনে ভারতের চাহিদা পূরণ হলে পরে বাংলাদেশের পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই উদ্দেশ্যে ভারত ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আর একইসাথে জানিয়ে দিয়েছে, ভারতের লোকজন ভ্যাকসিন নেওয়ার পরবর্তীতে রপ্তানিযোগ্য ভ্যাকসিন থাকলে রপ্তানি করা হবে। যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভ্যাকসিন আমদানি-রপ্তানি ক্ষেত্রে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে চুক্তি হয়েছে সেটাতে ভারতের ভ্যাকসিন রপ্তানি নিষিদ্ধের কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে সংশ্লিষ্ট মহল মন্ত্রীর এ কথায় আশ্বস্থ হতে পারছেন না। ভারত ঘোষিত ভ্যাকসিন রপ্তানি নিষিদ্ধে বাংলাদেশের যথাসময়ে ভ্যাকসিন না পাওয়ার আশঙ্কা বেড়েছে বলে মনে করেন তারা।
রবিবার (৩ জানুয়ারী)অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা রপ্তানিতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিরাম ইনস্টিটিউটের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত। এই নিষেধাজ্ঞা আগামী কয়েকমাস বহাল থাকবে। এর ফলে বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোকে করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজের জন্য আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হতে পারে।
গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সিইও আদর পুনাওয়াল্লা বলেন, ‘রোববার ভারতীয় নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ ভ্যাকসিনের জরুরি অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু শর্ত হলো, ঝুঁকিতে থাকা ভারতীয় জনগণের জন্য ডোজ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য রপ্তানি করতে পারবে না সিরাম ইন্সটিটিউট।’
এই সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ অবৈধ মজুত ঠেকানো উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এই মুহূর্তে শুধুমাত্র ভারতীয় সরকারের কাছে ভ্যাকসিন হস্তান্তর করতে পারব।’
পুনাওয়াল্লা জানান, সিরাম এই মুহূর্তে বেসরকারি বাজারেও এই ভ্যাকসিন বিক্রি করতে পারবে না।
এর আগে, আগ্রহী দেশগুলোতে রপ্তানির আগে আগামী দু’ মাসে ভারতের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে গুরুত্ব দেয়ার কথা এদিনই জানিয়েছিল সিরাম।
সেরাম ইনস্টিটিউট এক সভায় জানায়, যেসব দেশ তাদের টিকা নিতে আগ্রহী, তাদেরকে দেয়ার আগে দু’মাস ভারতের তাৎক্ষণিকভাবে কী পরিমাণ টিকার প্রয়োজন, তা উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে চায় তারা।
এদিকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব তাদের সঙ্গে করা বাংলাদেশের চুক্তির ওপর প্রভাব ফেলবে না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান।আগামী মাসের (ফেব্রুয়ারি) মধ্যেই ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
সোমবার (৪ জানুয়ারি) সচিবালয়ে করোনা ভ্যাকসিন রপ্তানিতে ভারতে নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে জরুরি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান সচিব। এ সময় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক উপস্থিত ছিলেন।
স্বাস্থ্যসেবা সচিব বলেন, ‘আমি এখনই ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনরাকে ফোন করলাম। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, আমরা যে চুক্তি করেছি, এটার ফিন্যান্সিয়াল কতগুলো ট্রানজেকশন, কীভাবে টাকাটা যাবে, কীভাবে ব্যাংক গ্যারান্টি দেবে! কাজটি হয়েছে জি-টু-জি বা সরকার টু সরকার। যে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞার কথা ভারত সরকার বলেছে শুধু কমার্শিয়াল অ্যাকটিভিটিজের ওপর, আমাদেরগুলোর ওপর নয়। কারণ আমাদেরটা সরকার টু সরকার।’
আব্দুল মান্নান বলেন, ‘যেটা আপনারা বলেছেন, আশঙ্কা করার মতো, দুশ্চিন্তা করার মতো এখনো কিছু হয়নি বলে আমি মনে করছি, স্যারও (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) তাই মনে করছেন।’
এসময় ভারতের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, ‘আমরাও এ বিষয়টি নিয়ে সকাল থেকে কাজ করছি। জানতে পেরেছি। পুরোপুরি খবর আমরা এখনো অবহিত নই। ইতোমধ্যে বেক্সিমকো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতে আমাদের মিশনের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আমাদের মিশন ভারতের ফরেন মিনিস্ট্রির সঙ্গেও আলোচনা করেছে। ওনারা আশ্বস্ত করেছেন, আমাদের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে সেই চুক্তিটি ব্যাহত হবে না।’
ভারত সব দেশের জন্য এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আশ্বস্ত যে সমস্যা হবে না, আশা করি সমাধান হয়ে যাবে। আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।’
ভারতের সেরাম ইনন্সিটিউট থেকে তিন কোটি করোনা টিকা আনার কথা ছিলো বাংলাদেশের৷ এ নিয়ে গত নভেম্বরে সেরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকোর মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়৷ প্রতি ডোজ টিকার দাম ধরা হয় পাঁচ ডলার৷ পরিবহণ খরচ এক ডলার৷ বাংলাদেশ ও ভারত একই সময়ে একই দামে টিকা পাবে বলে চুক্তিতে লেখা ছিলো ৷ তিন কোটি টিকার প্রথম কিস্তির ৫০ লাখ চলতি মাসেই পাওয়ার কথা ছিলো৷ বাকি টিকা ধাপে ধাপে পাওয়া যাবে৷
২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কোভ্যাক্সের ২০ কোটি থেকে ৩০ কোটি ডোজ টিকা বাংলাদেশকে দেয়ার পরিকল্পনাও করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। তবে, ভারতের হঠাৎ এই নিষেধাজ্ঞায় সেটি হয়তো আরও কয়েক মাস বিলম্বিত করবে।
ভারতের কাছ থেকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন সরবরাহ নিয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে তা উড়িয়ে দিয়ে সোমবার (৪ জানুয়ারি) বিকেলে ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের জানান, ভারত থেকে যথাসময়েই ভ্যাকসিন পাবে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এ নিয়ে চিন্তিত বা আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
এদিকে জানা যায়, বর্তমানে ভারতের এক কোটিরও বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। যা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দেশটিতে প্রায় দেড় লাখ লোক ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হওয়ার পর মারা গেছেন।
জানা যায়, করোনা ভ্যাকসিন বণ্টন পরিকল্পনার শুরুতেই ভারত ৩০ কোটি জনগণকে টিকা দিতে চায়। যার মধ্যে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশসহ মহামারি মোকাবেলায় সামনের সারির যোদ্ধারা।
এদিকে, টিকা কিনতে বাংলাদেশ, সৌদি আরব, মরক্কোর সাথে চুক্তি হয়েছে সেরাম ইন্সস্টিটিউটের। পুনেওয়াল্লা জানান, এরমধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশই আগে পাবে ভ্যাকসিন।
অন্যদিকে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন, সিরাম ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ সরকার ও বেক্সিমকোর মধ্যে যেহেতু চুক্তি হয়ে গিয়েছে, টিকা আসতে সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ নেই। সিরামের পক্ষ থেকেও এমন কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়নি যে করোনার টিকা আসতে দেরি হতে পারে।
ভারত সরকারের টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের খবর নিয়ে জানতে চাইলে গতকাল তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের এ কথা বলেন নাজমুল হাসান পাপন। তিনি বলেন, যে নিউজটার কথা উঠেছে, আমিও শুনেছি। আমি, আমরা এখনো এটি নিয়ে অত চিন্তিত না। কারণ আমাদের চুক্তি হয়ে গেছে। চুক্তিতে পরিষ্কার বলা রয়েছে, আমাদের দেশে অনুমোদন দেয়ার এক মাসের মধ্যে তাদের (সিরাম ইনস্টিটিউট) টিকা দিতে হবে। এটি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি।
তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের চাহিদা মিটার পর বাংলাদেশের টিকা পাবার সম্ভাবনা এমনিতেই ক্ষীণ। তারওপর রয়েছে ভারত থেকে ভ্যাকসিন আমদানি করার প্রতিযোগিতা। সেখানে বাংলাদেশ কতটা পেরে উঠবে, কতটা সফল হবে এই নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। একই সাথে মনে করেন, ভারতের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে বাংলাদেশে নির্দিষ্ট সময়ে ভ্যাকসিন আসার সম্ভাবনা আরো সংকুচিত হয়ে গেলো। ভারত ছাড়াও অন্যান্য দেশের সাথে ভ্যাকসিন আমাদানি করার আলাপ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দেন তারা। তারা মনে করেন, মহামারি এই রোগের জন্য কেবল একদেশের দিকে তাকিয়ে না থেকে বাংলাদেশের উচিত অন্যান্য দেশগুলোর সাথেও কার্যকর আলোচনা করা। ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ করে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন আসার ক্ষেত্রে অনেক বিলম্ব হতে যাচ্ছে আর এতে দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে আরো জটিলতর অবস্থানে চলে যেতে পারে, এবিষয়েও তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৫
আপনার মতামত জানানঃ