এই প্রজন্মের তরুণদের নিয়ে অনেকেই অভিযোগ করেন, তরুণরা সব কাজে শর্টকাট খোঁজে। আগেকার সময়ে মানুষের অনেকবেশি পরিশ্রম করার অভ্যাস ছিল। তা একটা সাধারণ অঙ্ক করাই হোক, কিংবা ভারী কাজের বোঝা মাথায় নিয়ে দিনরাত একনাগাড়ে খাটুনি।
অথচ এখন যেন ক্যালকুলেটর ছাড়া ছোট অঙ্কেরও উত্তর মেলে না। কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই ঘাটতে হয় না, স্রেফ একটা গুগল সার্চেই উত্তর মেলে। কলম ব্যবহার করে খাতায়ও লেখা হয় না। কম্পিউটারের কি-বোর্ড থেকে শুরু করে স্মার্টফোনের অতিসংবেদনশীল পর্দা, অ্যাপলের সিরি, গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা অ্যামাজন অ্যালেক্সা, বিচিত্র নানা প্রযুক্তির মিশেলে জীবন অনেক বদলে গেছে। এসব প্রযুক্তি যেমন জীবনকে অনেক সহজ করছে, তেমনি তা কাজের আউটপুট বা ফল বাড়িয়েছে।
যেমন, কয়েক দশক আগেও যে কাজটি করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হতো, সময়সাপেক্ষ সেই কাজ এখন কয়েকটি বোতাম টিপে মুহূর্তেই করে নেওয়া যাচ্ছে। একেই বলছি ‘শর্টকাট’। যার সর্বশেষ সংযোজন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বিভিন্ন স্মার্ট ডিভাইসের মাধ্যমে দিন দিন তা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে মানুষের সঙ্গে।
গত কয়েকমাস ধরেই ওপেন এআই-এর তৈরি চ্যাটজিপিটি নিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনকুবের টেসলা’র মালিক ইলন মাস্ক এর উদ্যোক্তা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা চোখে পড়ছে। এর আগে মাস্কের প্রতিষ্ঠান এমন গাড়ি তৈরি করে দেখিয়েছে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
এছাড়া তার প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে নিউরালিংক ডিভাইস, যা মূলত মস্তিষ্ককে সরাসরি কম্পিউটারের সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দিতে পারে। ফলে কোনো শারীরিক কর্মকাণ্ড ছাড়াই শুধু চিন্তা করে কম্পিউটারের মতো ডিভাইসকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্য প্রাণীর ওপর সফলও হয়েছে এই গবেষণা।
চ্যাটজিপিটিও প্রতিনিয়ত নিজেকে আপগ্রেড করছে। তবে কেউ কেউ বলছেন, এই অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে সৃজনশীলতা বা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার জায়গা সংকুচিত হবে। আবার কেউ বলছেন, কম সময়ে বেশি কাজ করার জন্য এমন প্রযুক্তির বিকল্প নেই। কিন্তু কোনটি গ্রহণ করবে তরুণরা?
দৈনন্দিন জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যেমন কোনো চাকরির জন্য সিভি ও কভার লেটার তৈরি করা, কোনো একটি বিষয়ে গবেষণা করতে চাইলে সে সংক্রান্ত আউটলাইন তৈরি, জটিল বিষয়ের সহজ সংজ্ঞা, মৌলিক কোনো লেখা তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্যের যোগান সহ নানা কাজ করে দিচ্ছে চ্যাটজিপিটি। অথচ এসব কাজ করার জন্য এতদিন নিজেকেই শ্রম দিতে হতো। বিভিন্ন রিসোর্স, ডেটা মডেল ও ব্যবহারকারীদের প্রশ্নের ধরন বিবেচনা করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কার্যক্ষমতাও দিন দিন বাড়ছে।
তবে এর যে বিভ্রম ঘটছে না, তা কিন্তু নয়। যেমন একে যদি কোনো অপরিচিত ব্যক্তি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, কাছাকাছি নামের কয়েকজন ব্যক্তির তথ্য একত্রিত করে তা কোনো একটা উত্তর বানিয়ে দেবে। কারণ, এই চ্যাটবটের কাজ হচ্ছে, সার্চ ইঞ্জিন থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে কোন শব্দের পর কোন শব্দ আসবে সেই সম্ভাবনা বিবেচনায় একটা আনুমানিক উত্তর দেওয়া। যদি প্রেমিকার জন্য প্রেমপত্র লিখতে বলা হয়, সে তা ভালোই পারবে। কিন্তু অনেকধরনের গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণার ব্যাপারে সে সঠিক তথ্য নাও দিতে পারে।
এআই এবং মনস্তত্ত্ব নিয়ে কার সঙ্গে কথা বলব, সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। কারণ আমাদের জীবনে এআই-এর ব্যবহারের প্রভাব কোন মাত্রায় পৌঁছাতে পারে, সে বিষয়ে অনেকেই এখনো সন্দিহান। তাই মনে পড়লো কিছুদিন আগের কথা। এখনকার তরুণরা অনেক অস্থির কেন, কিংবা কোনো কাজে সফল হতে না পারলে ভেঙে পড়ে কেন, এই মনস্তত্ত্বের কারণ জানতে চেয়ে প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. মোহিত কামালকে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘ছোটবেলায় সাপলুডু খেলার সময় গুটি যখন সাপের পেটে চলে যেতো, তখন আমরা আহা-উঁহু করেও তা মেনে নিতাম।
নতুন করে আবার খেলা শুরু করতাম। এখনকার তরুণরা এসব খেলাধুলা থেকে অনেক দূরে। তারা সবকিছুর ক্ষেত্রেই নিজের অনুকূলে ফলাফল চায়। হার মেনে নতুন ছক কষতে চায় না।’ এই কথা মনে পড়ায় আমার মনে হলো, একজন তরুণ যখন কলেজের অ্যাসাইনমেন্ট থেকে শুরু করে অনেক কাজেই চ্যাটজিপিটি-তে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে, তখন যদি চ্যাটবট কোনো কারণে বেঁকে বসে, তখন ওই শিক্ষার্থী নিজের কাজ সামাল দেবে কেমন করে? প্রযুক্তির প্রতি এইধরনের অভ্যস্ততা কি তার সৃজনশীলতা বিকাশের ক্ষেত্রে চরম বাধা নয়?
অবশ্য প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, আগামীতে বিশ্বের জন্য একটি বড় পরিবর্তনের নিয়ামক হয়ে উঠতে চলেছে এআই। যদিও এআই মডেলগুলোর কোনো নিজস্ব সৃজনশীলতা বা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নেই। বিভিন্ন মানুষের চিন্তার কিছু কিছু অংশ আয়ত্ত্ব করে একধরনের ট্রেইন্ড ডেটার ওপর ভিত্তি করে এটি কাজ করে। কমান্ড দিলেই হয়তো সে বিখ্যাত কোনো লেখকের লেখার ধরন অনুকরণ করে কিছু একটা লিখে দেবে।
আপাতদৃষ্টিতে একে অগণিত মানুষের সমান কাজ একমুহূর্তে করতে সক্ষম বলে মনে হলেও, মানবমস্তিষ্কের মতো বহুমাত্রিক ক্ষমতা এআই-এর নেই। তাই আরেকজন শেক্সপিয়ার, আর্থার কোনান ডয়েল বা ভিক্টর হুগোকে কখনো তৈরি করতে পারবে না এআই। যেহেতু সে পুরনো তথ্যকে পুনর্বিন্যাস করে কাজ করে, ফলে রক্তমাংসের মানুষের সৃজনশীলতার গুরুত্ব কমার সুযোগ নেই। ঠিক এই জায়গায় সচেতন হতে হবে আমাদের।
আমরা জানি, গুগলের সার্চ ইঞ্জিনও এআই নির্ভর। অনেক তথ্যের ভেতর থেকে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক তথ্য সে বের করে নিয়ে আসে। তবে চ্যাটজিপিটিকে বলা হচ্ছে আরও সুবিধাজনক প্রযুক্তি। কারণ এতে সার্চ করে অনেকগুলো লিংক দেখতে হয় না। বরং একটা প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে দেয়। যেকোনো রচনা লেখা থেকে শুরু করে গানের লিরিক, গল্প লেখা, এমনকি কবিতা লিখতেও সক্ষম এই চ্যাটবট, তবে তা অবশ্যই বিভিন্ন উদাহরণ অনুসরণ করে।
সফটওয়্যার প্রকৌশলী ত্রিভুজ আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘কত কম সময়ে কত বেশি শেখা যায় সেটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সেজন্য আবার চ্যাটজিপিটির মতো বুদ্ধিমত্তা থেকে সরাসরি তথ্য নিলেও সমস্যা। কারণ, এতে শেখায় গ্যাপ তৈরি হবে। জ্ঞানের কোন শর্টকার্ট নেই। সে কারণে গাইডলাইন ছাড়া এআই টুলগুলো ব্যবহার করা নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য বিপজ্জনক। এজন্য এআই ব্যবহার করার নিরাপদ উপায় সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। শিক্ষকদেরও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সরকারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।’
তনয় মোস্তাফিজ নামের একজন চিকিৎসক বলেছেন, ‘একটা পরীক্ষার প্রশ্ন বানানোর জন্য কিছু ইনস্ট্রাকশন দেওয়ার পর চ্যাট জিপিটি বা গুগলের বার্ড দারুণ ফলাফল দিয়েছে। বোঝাই যায় না এটা এআই-এর কাজ। সামনের দিনগুলোতে বাকিদের সাথে আপনার-আমার পার্থক্য গড়ে দেবে, আমরা কে কতো ভালোভাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি —সেই দক্ষতা।’
প্রখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী ড. রাগিব হাসান বলেছেন, ‘গত এক বছরে প্রোগ্রামিংয়ের জগত পাল্টে গেছে। জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এসে মামুলি ধরনের কোডিংয়ের কাজকে স্বয়ংক্রিয় করে ফেলেছে। তাই এন্ট্রি লেভেলের প্রোগ্রামারদের এখন আর দরকারই নাই। সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে শুরুর দিকের যেসব কাজ ছিল, তার প্রায় সবটাই এআই দিয়ে করা যাবে অচিরেই। প্রোগ্রামিংয়ের জন্য দরকার হবে কেবল অল্প কয়েকজন হাই-স্কিল্ড এআই ডেভেলপার।’
তিনি বলেন, ‘সবশেষ কবে আপনি বড় সংখ্যার হিসাব হাতে করেছেন? মনে করতে পারবেন না, কারণ এখন ক্যালকুলেটর আছে। এভাবেই ট্র্যাডিশনাল অনেক স্কিল আর দরকার হবে না। তাই আশা করি, স্কুলের নিচের ক্লাস থেকে প্রোগ্রামিং শেখানোর যে জোয়ার শুরু হচ্ছিলো, যার কারণে গ্রামের মফস্বলের বা শহরের সবাইকে প্রোগ্রামার বানানোর শিক্ষা জোর করে দেওয়া হচ্ছিলো, তা আর প্রয়োজন নেই। বরং এর বদলে ভাষা, বিজ্ঞান, গণিত, নৈতিক বা ধর্মীয় মূল্যবোধ —এসব চিরন্তন বিষয়েই আবার জোর দেওয়া দরকার। তবেই তরুণরা সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নেবে। তবে হ্যাঁ, যেসব কাজে এআই ব্যবহার করা যেতে পারে, সেসব ক্ষেত্রে এআই-এর সঠিক ব্যবহারের দক্ষতা আয়ত্ত্ব করতে হবে।
ভালো কথা, চ্যাটজিপিটি কিন্তু এখনো ঠিকভাবে বাংলা ভাষা লেখা শেখেনি। প্রশ্ন করলে ভুলভাল বাংলায় উত্তর দেয়। এই সীমাবদ্ধতা থাকায় কিছুটা ঘাঁটাঘাঁটি করে এই লেখাটি লিখবার সুযোগ পাওয়া গেল! এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা প্রতিদিনকার অতিসাধারণ কাজের বেলায়ও আমাদের মাথা একটা এআই টুলকে খেয়ে ফেলতে দেবো কিনা, নাকি একে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বরং নতুন ও উদ্ভাবনী কিছু করব।
এসডব্লিউ/এসএস/২০০০
আপনার মতামত জানানঃ