কাজী ফয়সাল : সিরাজ সিকদার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বড় অধ্যায়ই শুধু নয়, নামটি এখনো সমানতালে প্রাসঙ্গিক ও আকর্ষণীয়। হত্যার এতো বছর পরেও দেশের আপামর মানুষের কাছে মুক্তির আরেক নাম সিরাজ সিকদার। ইদানীং যদিও ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বহুল ব্যবহারে জীর্ণ, তবুও এ শব্দটি যদি দেশের কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নামের আগে ব্যবহার করা যায়, তাহলে সিরাজ সিকদারই হতে পারেন তার সবচেয়ে অগ্রসর দাবিদার। শুধু বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা বা প্রচার করা নয় নিয়োজিত ছিলেন বিপ্লব সংঘটনের বাস্তব লড়াইয়ে। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সামনে থেকে জীবন বিপণ্ন করে।
প্রকৃত বিপ্লবী তথা পরিবর্তনকামী হওয়ায়, কায়েমি স্বার্থের ঝাণ্ডাধারীরা তাকে শুধু হত্যা করেই শান্ত হয়নি, বরং তারা এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সিরাজ সিকদারের নাম, আদর্শ ও তার অবদানকে মুছে ফেলতে। কিন্তু সিরাজের সাহস, কর্ম এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বিশালতার কাছে কোনো প্রোপাগাণ্ডাই দাঁড়াতে পারেনি। মুক্তির দূত, লড়াইয়ের অগ্রসেনা হয়েই জনগণের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। মহান এই বাঙালি বিপ্লবীর আজ ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। বিভিন্ন কর্মসূচির সমন্বয়ে দেশজুড়ে মুক্তিকামী জনগণ আজ দিবসটি উদযাপন করছে।
প্রতিবারের মতো এবারও এ উপলক্ষ্যে দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে শহীদ বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিক স্মৃতি সংসদ। সকালে অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রতিবাদ মিছিল, রাজধানীর মোহাম্মদপুর কবরস্থানে সিরাজ সিকদারের সমাধিতে পুস্পমাল্য অর্পণ ও শপথ গ্রহণ। শহীদ বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিক স্মৃতি সংসদের সভাপতি কমরেড হাসান ফকরীর নেতৃত্বে এসব অনুষ্ঠান পালিত হয়। তারই নেতৃত্বে বিকেল ৩টায় ২২/১ তোপখানা রোডস্থ শিশুকল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
সিরাজ সিকদারকে শুধু রাজনীতিবিদ আখ্যা দিলে খুব কম বলা হবে। তিনি একাধারে মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক, সংগঠক, লেখক-কবি এবং গেরিলা যোদ্ধা। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সিরাজ সিকদার পড়াশোনা করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে। এখানে অধ্যয়নকালেই তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়। ১৯৬৭ সালে যখন গোটা দুনিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভাজনের পথে ধাবমান, তখন তিনি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি নির্বাচিত হন। একই সময়ে সীমান্তের ওপারে ভারতবর্ষকে জাগিয়ে তুলছেন আরেক নেতা চারু মজুমদারের নকশাল আন্দোলন। সিরাজ সিকদার নকশাল আন্দোলনের চিন্তা ও পথধারা কর্তৃক ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেই অর্থে তাকে চারু মজুমদারের উত্তরসূরী দাবি করা যেতে পারে।
মতাদর্শের দিক থেকে সিরাজ সিকদার প্রবলভাবে মাও সেতুং-এর অনুসারী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সশস্ত্র বিপ্লবে। সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া কৃষক, শ্রমিকদের মুক্তির ভিন্ন কোন পথ আছে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি ১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারি গড়ে তোলেন বিপ্লববি সংগ্রামের আরেক নতুন অধ্যায় ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’। এ সময় সিরাজ সিকদার তার বিখ্যাত থিসিস উপস্থাপন করেন এবং তাতে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে বাম রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নজরে আসেন।
ওই থিসিসে তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের উপনিবেশ বলে আখ্যা দেন, এখানে সামন্তবাদী কায়দায় শোষণ হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। বিচ্ছিনতাবাদী বা দেশদ্রোহীর মতো গুরুতর অভিযোগ ওঠার শঙ্কা জেনেও স্বাধীনতা অর্জনে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানান। এছাড়াও থিসিসে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিকে- বর্তমানে যা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) নামে পরিচিত- সংশোধনবাদী পার্টি বলে অভিহিত করেন। এই পার্টি প্রকৃতপক্ষে শোষক শ্রেণি অর্থাৎ উপনিবেশবাদী, সামন্তবাদী, পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিনিধি হয়ে পূর্ব বাংলার শ্রমিক কৃষকদের বিপথে চালিত করছে বলে সিরাজ সিকদার অবস্থান গ্রহণ করেন।
১৯৭০ সালের মধ্যে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন পাকিস্তান প্রশাসন ও শ্রেণী শত্রু বিরুদ্ধে বেশকিছু গেরিলা অপারেশান চালিয়ে দেশ ব্যাপী পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। ওই বছরের ৮ জানুয়ারি তারা ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ জেলা ও ময়মনসিংহে স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। মিলিটারি শাসনে অস্ত্রের মুখে কোণঠাসা থেকেও এরকম সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়া মানুষের সংখ্যা পূর্ব বাংলার ইতিহাসে বিরল। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবর রহমানের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠিতে জাতীয় মুক্তি পরিষদ গঠনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করার আহ্বান জানান সিরাজ সিকদার। যদিও আওয়ামী লীগ সরকার ওই চিঠির আহবান প্রত্যাখ্যান করে এবং পাকিস্তানিদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যায়। সিরাজ সিকদার যযদিও ওই খোলা চিঠিতে পাকিস্তানিদের বিশ্বাস করার সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু শেখ মুজিবের নেতৃত্ব তার সাবধানবাণী আমলে নেয়নি, যার দায় লাখ লাখ মানুষকে জীবন দিয়ে মেটাতে হয়েছে। রাজনীতিতে সিরাজ সিকদারের অগ্রসরতার সাক্ষ্য দেয় এই ঘটনা।
এরপর এগিয়ে আসে একাত্তরের যুদ্ধ। ওই যুদ্ধে বিভিন্ন গোষ্ঠীর অবদান এবং তৎপরতার বিষয়গুলো যত্নসহকারে লিপিবদ্ধ হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। পিকিংপন্থীদের (মাওবাদী) নিয়ে প্রচলিত জনপ্রিয় ধারণা হলো তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, বরং বিরোধিতা করেছে। সত্যিকারার্থে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে চীনের অবস্থান আসলেই পিকিংপন্থীদের দোলাচলে ফেলে দেয়। কিন্তু পার্টির ছোট ছোট অংশ ও বিভিন্ন গ্রুপ স্বতন্ত্রভাবেই বিভিন্ন অঞ্চলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এদের অন্যতম হল সিরাজ সিকদারের সংগঠন।
১৯৭১ সালের ৩০শে এপ্রিল বরিশালের পেয়ারা বাগানে গঠন করেন “পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী” যার নাম পরবর্তীতে ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’ রাখা হয়। ১৯৭১ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে থেকে লড়াই-সংগ্রাম করেছে মূলত এ দেশের বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি ও গ্রুপ, যার মধ্যে সর্বহারা পার্টি অন্যতম। সর্বহারা পার্টি আওয়ামী লীগ সহ অনেক স্থানীয় জনগনকে দল্ভুক্ত করে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে বরিশালের পেয়ারা বাগানে। দেশীয়ভাবে তৈরিকৃত এবং লুটপাট করা অস্ত্র দিয়েই চলে তাদের চারু মজুমদারের রণকৌশলে পরিচালিত গেরিলা যুদ্ধ। স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর সাথে ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা করলেও কোনো সাড়া পাননি। তবে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন নিজেদের প্রচেষ্টায়। কিন্তু সিরাজ সিকদার এবং সর্বহারা পার্টির স্বাধীনতা যুদ্ধের অবদানকে সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন সুবিধাবাদী ইতিহাসবিদরা। পরবর্তী সরকারগুলোও মুছে দিতে চেষ্টা করেছে বিপ্লবের অগ্রদুত সিরাজ সিকদারকে।
বাংলাদেশ স্বাধীন ঘোষিত হলেও সিরাজ সিকদার লক্ষ্য করেন জনগণের প্রকৃত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি অধরাই রয়ে গেছে। পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে ভারতীয় উপনিবেশে স্থানান্তর হওয়া ছাড়া বিশেষ কোনো অগ্রগতি না দেখায় অসমাপ্ত এই যুদ্ধ তিনি ও তার বাহিনী অব্যাহতভাবে চালিয়ে যান। যার অর্থ হল একাত্তরের যুদ্ধ আসলে একাত্তরেই শেষ হয়নি। মুক্তিসংগ্রামীরা সেই যুদ্ধটি শুরু করেছিলেন ষাট দশকে। একাত্তরে পরাজয়ের পরও তারা থামেননি। সিরাজ সিকদার হত্যার আগ পর্যন্ত এই মুক্তির লড়াই অব্যাহত ছিল। তাকে হত্যার পর এই মুক্তির লড়াই নতুন যুগে প্রবেশ করে।
একাত্তরের যুদ্ধ যে জনগণের মুক্তি আনতে পারেনি, এটা যে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে ওঠেনি তার প্রমাণ মেলে সিরাজ সিকদারের আহবানে তরুণদের সাড়া দেখে। সে সময় সিরাজের নেতৃত্বে ছাত্র-তরুণদের অংশগ্রহণে, শ্রমিক কৃষকের ওপর ভিত্তি করে অচিরেই গণমানুষের দলে পরিণত হয় সর্বহারা পার্টি। পার্টির গেরিলারা ৭৩-৭৪ সালে ১৪টি থানা এবং ৭৯টি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র কমিউনিস্ট পার্টিতে পরিণত হয়। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে সর্বহারা পার্টি ১৬ই ডিসেম্বরকে কালো দিবস আখ্যা দিয়ে দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে এবং গ্রামাঞ্চলে ও অনেক ছোট শহরে সে হরতাল পালিত হয়। মওলানা ভাসানীও ওই হরতালে সমর্থন দিন। আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব তখন বিপুল জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তাদের আহবানে বিজয় দিবসস উদযাপন না করে বিপুল জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তখন সিরাজ সিকদারকে মোকাবিলার রাজনৈতিক পথ অনুসরণ না করে হামলা, মামলা, নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড দিয়ে তারা এই রাজনৈতিক উত্থানকে স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা চালায়।
উপর্যুপরি অভিযানের এক পর্যায়ে ১৯৭৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে ধরা পড়ার পরে সিরাজ সিকদারকে ঢাকায় আনা হন এবং ২ জানুয়ারী ১৯৭৫ সালে রক্ষীবাহিনীর কেন্দ্রীয় দপ্তর সাভারে তাকে হত্যা করা হয়। এটা ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর জিম্মায় প্রথম আলোচিত বিচার বহির্ভূত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, যা পরবর্তীকালে বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সিরাজ সিকদার হত্যাকাণ্ড ছিল বিপ্লবী সংগ্রামের ওপর এক তীব্র আঘাত। এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল যে, সিরাজ হত্যার বিচার চাইতে প্রায় দুই দশক লেগ গেছে। তবে ১৯৯২ সালে মামলা করা হলেও আজও চাঞ্চল্যকর এই খুনের বিচারে রাষ্ট্রপক্ষের আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয়নি।
এটা পরিষ্কার যে, মাত্র ৩০ বছরের ওই তরুণ প্রাণ ছিলেন অন্যায়, অনাচারের বিরুদ্ধে সাহস ও প্রতিরোধের প্রতীক। যে কারণে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বিশাল সব রাজনৈতিক নেতাদের অতিক্রম করে গিয়েছিলেন তিনি। সাহসের সঙ্গে দুঃসময়কে মোকাবিলার পথ দেখিয়েছেন সিরাজ। বাংলাদেশে আজ এটারই সবচেয়ে বেশি অভাব দেখছেন জনগণ। আর এ কারণেই সিরাজ সিকদারকে মুছে ফেলা যায়নি শত চেষ্টা সত্ত্বেও। অন্ধকার যত গভীর সিরাজ সিকদার তত বেশি উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকার নাম, যিনি আজো লাখো তরুণের বুকে জাগিয়ে তুলছেন মুক্তির স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে মূর্ত করতে চাই শোষণের শেকল ভাঙার দৃঢ় প্রত্যয়। ২ জানুয়ারি তেমনই এক শপথ গ্রহণের দিন।
এসডাব্লিউ/কেএফ/আরা/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ