তাহমিনা রহমান
১৯৯০ সাল থেকে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো দেশের গণতান্ত্রিক একীভূতকরণে ব্যর্থ হয়েছে। ঔপনিবেশিক যুগ থেকে বর্তমান দিন পর্যন্ত সেই ব্যাখ্যাই পাওয়া যায়।
গণতন্ত্রের উপর বেশ কিছু সূচক বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে “আধা-স্বৈরাচারী” “হাইব্রিড” বা শুধুমাত্র “আংশিক মুক্ত” হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ১৯৯০ এর দশকের শুরু থেকে ২০০০-এর শেষের দিকে পুনঃগণতন্ত্রীকরণের প্রতিশ্রুতি দেখানো সত্ত্বেও, দেশটি “গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ” এর পথে ফিরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে।
২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়। যা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত আন্তর্জাতিক আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা এবং অন্যান্য অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ ট্রাইব্যুনাল দেশে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণকে ত্বরান্বিত করেছিল। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে ফাটল দেখা দেয় (বাম/ডান বিভাজনের প্রতিফলন) এবং দুটি বিরোধী গণ আন্দোলন হয়। ট্রাইব্যুনালের সফল সমাপ্তির মাধ্যমে এই যুদ্ধে ট্রাইব্যুনালপন্থী ও বাম শক্তিরা জয়ী হয়। কিছু বিশেষজ্ঞ দাবি করেন, আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর এমন নীতি প্রণয়ন করেছে যা মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংখ্যালঘু অধিকার এবং নারীর ক্ষমতায়নকে ক্ষুণ্ন করে, গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ এবং দেশকে সামগ্রিকভাবে ডানপন্থায় ধাবিত করে। এর উপরে, অন্যরা যুক্তি দেখান যে, আ’লীগের নীতিগুলো বিরোধীদের আরও প্রান্তিকে ঠেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো আজ ধুঁকছে। মধ্য-ডান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট থেকে এখনো উঠে দাঁড়াতে পারেনি এবং ২০১৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগে কারাবন্দী দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার বিষয়ে আগের অবস্থানেই আছে। ২০২০ সালে একটি সরকারি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে কিছু শর্তে জামিন দেওয়া হয়েছিল। যদিও সরকার ২০২২ সালের মার্চ মাসে পঞ্চমবারের মতো জামিনের মেয়াদ বাড়িয়েছিল। বিএনপি নেতৃত্ব এখনো দমন-পীড়নের অভিযোগ করে আসছে কেবল।
অন্য কেন্দ্র-ডান দল, জাতীয় পার্টি (জাপা), ৩৫০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে মাত্র ২৬টি আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসাবে নিজেদের ভূমিকা বজায় রাখতে লড়াই করছে। এদিকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী অতি-ডানপন্থী দল বাংলাদেশ জামায়াত-ই-ইসলামীর (বিজেআই) নিবন্ধন নেই। আরেকটি অতি-ডানপন্থী দল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তৃতীয় স্থান অধিকার করে। কিন্তু সংসদে একটি আসনও দখল করতে পারেনি। ডানপন্থী দলগুলোর নির্বাচনী হুমকি বাদেই, কিছু বামপন্থী দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী এবং নির্বাহী জোট থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতির ডানদিকে ঝুঁকে পড়া খুবই বিভ্রান্তিকর।
এই জটিলতা পর্যবেক্ষকদের অবাক করে যে, কেন বামপন্থী দলগুলো তাদের প্রভাব প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে! কেন ব্যর্থ হয়েছে দেশের ডানদিকে ঝুঁকে পড়া রুখতে এবং ক্রমাগত কর্তৃত্ববাদ পরিবর্তনে! আজকের বাংলাদেশে, এই দলগুলোকে একজন বিশেষজ্ঞ “অণুবীক্ষণিক অবস্থা” বলে অভিহিত করেছেন। যদিও প্রকৃতি এবং আদর্শের দিক থেকে একচেটিয়া নয়, বাংলাদেশের বাম দলগুলো সাংগঠনিক এবং আদর্শগত সীমাবদ্ধতাগুলো ভাগাভাগি করে নিয়েছে, যার ফলে রাজনীতির মাঠে প্রভাবশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসাবে নিজেদের তুলে ধরতে পারছে না।
এই নিবন্ধে ঊনচল্লিশজন বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে চারটি ফোকাস গ্রুপ আলোচনা বিশ্লেষণ করা হবে। একইসাথে চারটি বামপন্থী দলের প্ল্যাটফর্ম, তাদের ইশতেহার এবং ‘৯০ পরবর্তী গণতান্ত্রিক একত্রীকরণে সহায়তায় তাদের ব্যর্থতার গুণগত বিশ্লেষণ করা হবে। এতে ঔপনিবেশিক যুগে বাম দলগুলোর ইতিহাস থেকে শুরু করে দেশের কর্তৃত্ববাদী বা সামরিক শাসনের অতীতের ভূমিকা এবং কীভাবে বড় দলের জোটে থেকে বাম দলগুলোর কাজ করার অভ্যাস বাম রাজনীতিকে সীমিত করে তুলেছে, তা বিশ্লেষণ করা হবে। তারপরে, নিবন্ধটিতে দলগুলোর মতাদর্শগত এবং সাংগঠনিক চ্যালেঞ্জগুলো সনাক্ত করবে, যা দলগুলোর সাফল্য এবং তৃণমূলে সংগঠিত হতে সহায়তা করতে পারে। যার মধ্যে বামদের “অভিজাত” এবং “নাস্তিক” হওয়ার খ্যাতি, জনসাধারণের মাঝে পৌছাতে না পারার অক্ষমতাসহ আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্ব। পরিশেষে, বাংলাদেশের বাম দলগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে লেখাটি শেষ করা হবে।
বাংলাদেশে বাম দলগুলোর ইতিহাস
ভারতীয় উপমহাদেশের বামপন্থী দলগুলোর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের সুনিপুণ ইতিহাস রয়েছে। দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে, বাংলাদেশী বামপন্থীরা পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে। এসব দলের প্রকাশ্যে কাজ করার অনুমতি না থাকলেও কিছু দল আওয়ামী লীগের মাধ্যমে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে বাম দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে এবং এক সময় সরাসরি বিরোধিতা শুরু করে। এমনকি ১৯৭২ সালে ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পর রাজনীতির মাঠে গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দল হয়েও কীভাবে একটি সামাজিক বিপ্লব করা যায়, সেবিষয়ে এখনো ঐক্যমতে আসতে পারেনি। ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থান আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়, কিন্তু বিরোধী রাজনীতি তখনো ঠাঁয় ছিল। পনের বছরের সামরিক শাসনের পর, দুটি কেন্দ্রবাদী দল ছোট বাম দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে জাতিকে সংঘবদ্ধ করে তোলে এবং ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।
তারপরও বাম দলগুলো জাতীয় নির্বাচনে ধুঁকছে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির (ডব্লিউপিবি) মতো সুপরিচিত দলগুলোর কিছু সংসদীয় প্রতিনিধি রয়েছে বটে, তবে তাদের নির্বাচনী এলাকা এবং ভোটার সংখ্যা খুবই কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিচালিত জরিপে ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (এফজিডি) উল্লেখ করে যে, বাম দলগুলো এতটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে যে বেশিরভাগ তরুণ ভোটাররা দুটির বেশি বাম দল বা তাদের নেতাদের নামও বলতে পারে না। অংশগ্রহণকারীরা স্বীকার করেছেন যে, দলগুলোর রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে তাদের খুব কম বা কোনো ধারণাই নেই। যদিও ভোটদানকারী শিক্ষার্থীরা গোটা জনসংখ্যার প্রতিনিধি করে না। তবে এফজিডি-তে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের মন্তব্য ইঙ্গিত করে যে, বাংলাদেশের বাম দলগুলো অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। তাদের এই সংকট স্বৈরাচারী শাসন এবং তাদের এজেন্ডা জনপ্রিয় করতে না পারার ফলে হয়েছে।
জোটের রাজনীতির কিছু সুবিধা ও লাভ আছে। এই সুবিধা এবং লাভ হারানোর ভয়ে বামরা কখনো নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষেত্রে, কখনো আইন পরিবর্তনের পক্ষে একটি নরম পন্থা অবলম্বন করে থাকে। এটাকে আমি সুবিধাবাদী প্রবণতা বলব।
বড় দলগুলোর মাধ্যমে রাজনীতি: দলীয় ক্ষমতা হ্রাস
এই লেখকের নেয়া সাক্ষাত্কারে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ যুক্তি দেখিয়েছেন যে, মধ্যপন্থী দলগুলোর তুলনায় বামপন্থী দলগুলোর স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরের অভাব রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে, বাম দলগুলো মূলধারার দলগুলোর মাধ্যমে রাজনীতি করে কর্তৃত্ববাদী বা সামরিক শাসকদের ক্রোধ এড়িয়ে চলে। স্বৈরাচারী শাসন এবং আইনি বাধাগুলো মূলধারার দলগুলোর সাথে তাদের জোটবাঁধা অপরিহার্য করে তুলেছিল। যেমন পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা এবং সামরিক একনায়কত্বের অবসান, কিন্তু এখানেও তাদের অস্তিত্ব মূলধারার দলগুলোর ছায়াতেই ছিল। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসনের অবসানের পর, জোটবদ্ধ রাজনীতি করার এই নির্ভরতা বেড়ে যায়। এমনকি নিজেদের এজেন্ডা বিসর্জন দিয়ে আপস করে হলেও। একজন প্রবীণ বাম রাজনীতিবিদ ব্যাখ্যা করেছেন:
“জোটের রাজনীতির কিছু সুবিধা ও লাভ আছে। এই সুবিধা এবং লাভ হারানোর ভয়ে বামরা কখনো নিপীড়ন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষেত্রে, কখনো আইন পরিবর্তনের পক্ষে একটি নরম পন্থা অবলম্বন করে থাকে। এটাকে আমি সুবিধাবাদী প্রবণতা বলব। এই সুবিধাবাদের কারণে, কখনো মাঠে, কখনো সংসদের ভেতরে কিংবা বাইরে, অথবা রাজপথে তাদের যেমনটি প্রত্যাশা করা হয় তারা তেমন হতে পারে না। এটি বড় দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠনের একটি জটিলতা।
এতেই বোঝা যায় যে জোটে থাকা বাম দলগুলো প্রায়শই কেন্দ্রবাদী দলগুলোকে জবাবদিহি করতে এবং বিকল্প নীতি প্রস্তাবের জন্য অতটা চাপ দিতে পারে না। নেতৃত্বস্থানীয় দলগুলোও বাম নীতির থোরাই কেয়ার করে এই নির্ভরতার সুযোগ নেয়। জাসদের রাজনৈতিক প্রস্তাব স্বীকার করেছে যে, আওয়ামী লীগের জোট অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও, তাদের সাথে ভাল আচরণ করা হয় না। এর অফিসিয়াল প্রস্তাব বলে,
১৪ দলীয় জোট এবং অতীতে মহাজোটের শরীক হওয়ায় জাসদের আসন সংখ্যা নিয়ে খুশি নন নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। নির্বাচনী জোটের ফলে জাসদকে যে পরিমাণ আসন দেওয়া হয়েছে তা দলের জন্য সম্মানজনক নয় বলে মনে করেন তারা। আমরা অবশ্যই এই পরিস্থিতির পরিবর্তন চাই। যদিও বাস্তবতা নির্মম। আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে দলের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে তা নিজেদের দুর্বলতার কারণেই হয়েছে। আমাদের দুর্বলতা আমাদের বাধ্য করেছে আসন বণ্টন নিয়ে এই সমঝোতা মেনে নিতে।
সুনামের ক্ষতি: “সম্ভ্রান্তবাদী” এবং “নাস্তিক” চিত্র
এফজিডিতে উত্তরদাতা এবং বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেছেন যে, ভারতীয় উপমহাদেশের বাম রাজনীতিবিদদের অভিজাত হিসাবে খ্যাতি রয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় ‘মার্কসবাদ’ খুব কমজনের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও শিক্ষিত তরুণ হিন্দুরা ‘ভদ্রলোক’ নামে পরিচিতি ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালির নবজাগরণের জন্য এই আলোকিত গোষ্ঠীর বিশেষ ভূমিকা ছিল কিন্তু বাস্তব জগৎ সম্বন্ধে তারা উন্নাসিক এবং আনাড়ি হিসাবেও বিবেচিত হয়েছিল।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর এই উপলব্ধি আরও গভীর হয়, যখন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ভয়ে অল্প সংখ্যক হিন্দু কমিউনিস্ট ভারতের পশ্চিমবঙ্গে না গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যায়। এদের মধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষক ছিলেন। তারা পেটি-বুর্জোয়া বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং ছাত্রদের মধ্যে বামদের কমিউনিস্ট ধারণার প্রচারকে সীমিত করে রাখে এবং তাদের অভিজাত খ্যাতি মজবুত করে তোলে। আইনি বিধিনিষেধ দলগুলোকে সমগ্র পাকিস্তানের সামরিক একনায়কত্বে অবাধে কাজ করতে বাধা সৃষ্টি করে এবং তাদের প্ল্যাটফর্ম প্রসারিত করার যেকোনো সুযোগই নস্যাৎ করে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাম রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের এখনো এভাবেই দেখে। বাম রাজনীতিবিদ এবং কর্মীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, এফজিডিতে উত্তরদাতারা তাদের “উন্নাসিক” এবং “অভিজাত” হিসাবে বর্ণনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির একজন অধ্যাপক আরামদায়ক শহুরে পরিবেশে থেকে বিপ্লবের কথা বলার প্রবণতাকে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বামদের ব্যর্থতার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন। তার ভাষায়:
“তারা ডে-ইন-ডে-আউট ভিত্তিতে ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন না, যেমন শেখ মুজিবুর রহমান করেছিলেন। . . . তাদের প্রবণতা যথাসম্ভব স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ না করে ভালো করার। মানসিকতা এ রকম যে, ‘আমি আমার বিশ্বাসের সঙ্গে আপস করব না, আবার ত্যাগ স্বীকার করব না। আসলে আমি কোনো ঝুঁকি নেব না।’এখানে আপস বলতে কৌশলগত সমঝোতা বলতে চাইছি। কিন্তু স্যুটকোর্ট পেছনে ফেলে ছয় মাসের জন্য বাংলাদেশকে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অন্বেষণ করার মতো কোনো প্রতিশ্রুতি নেই।”
এফজিডি’র প্রতিক্রিয়াগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, দলগুলোর এই কথিত অভিজাত মনোভাব বাম সংগঠনগুলোর ছাত্র ফ্রন্টগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। তরুণ বাম কর্মীদের একটি বদ্ধমূল বিশ্বাস যে, সমস্ত লোক তাদের রাজনৈতিক বার্তা বোঝার জন্য সমানভাবে সক্ষম নয় এবং তাই যারা বুঝতে চায় তাদের দিকেই চেষ্টা রাখা উচিত। অবশ্য তাদের কার্যক্রমের ঐতিহাসিক ক্ষেত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও তারা তেমন সমর্থন জোগাড় করতে পারেনি।
একজন বাম রাজনীতিবিদ অবশ্য এসবের বিরোধিতা করে দাবি করেছেন যে, তার দলের তরুণ কর্মীরা এখনও গ্রামাঞ্চলে সক্রিয়। যেখানে তারা কৃষক এবং হতদরিদ্র মানুষকে সংগঠিত করছে। যদিও তৃণমূলের সংহতি ‘৮০ এর দশকে যে স্তরে পৌঁছেছিল সেই স্তরে নাও হতে পারে, তবে ঐতিহ্যটি পুরোপুরি মারা যায়নি। তিনি বামদের ‘অহমিকা’ প্রবণতার কথা স্বীকার করেছেন। যা তাদের সুনামের ক্ষতি করেছে এবং বাম রাজনীতিবিদদের জনগণ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশে বামদের নাস্তিক হিসাবেও সুনাম রয়েছে। এই সুনামও দেশে বিদ্যমান নাস্তিক-বিরোধী হুজুগের কারণে শক্তিশালী তৃণমূল নেটওয়ার্ক এবং একটি স্থিতিশীল নির্বাচনী এলাকা তৈরি করা কঠিন করে তোলে। বাংলাদেশে, “আপনি যদি গ্রামাঞ্চলে যান এবং মানুষকে বলেন যে আপনি নাস্তিক, তারা আপনার দিকে এমনভাবে তাকাবে যেন তারা একটি সাপ দেখছে। বাঙালী মুসলমানরা ‘নাস্তিকতা’ শব্দটিতে খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।”
স্বাধীনতার আগে এবং পরে, সামরিক শাসকরা বামদের বিরুদ্ধে প্রচার প্রচারণা চালিয়েছিল। তাদের বিধর্মী, অবিশ্বাসী হিসাবে অভিহিত করেছিল। একজন প্রবীণ বাম রাজনীতিবিদ জানান যে “এই লেবেল সরানো যাবে না। এটা ছিল, আছে এবং সবসময় থাকবে।”
এফজিডিতে অংশগ্রহণকারীরা নিশ্চিত করেছেন, তাদের অধিকাংশই বাম রাজনৈতিক দলগুলোকে বর্ণনা করার জন্য “হেডোনিস্ট”, “অনৈতিক” এবং “নাস্তিক” ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার করে থাকে।
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড এবং ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে শাহবাগ আন্দোলনের আবির্ভাব হলে এই ধরনের মানহানি আরও শক্তিশালী হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ছাত্ররা ইসলামবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষতাকে উন্নীত করার জন্য ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনার মুখে পড়ে। তখন ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল কাউকে চিহ্নিত করার জন্য “নাস্তিক” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল। যদিও এর সাথে জড়িত কয়েকজন কর্মী স্বঘোষিত নাস্তিক ছিলেন। বাম রাজনীতিবিদদের ওপর এই ধরণের আক্রমণ আজও অব্যাহত রয়েছে। বিখ্যাত ধর্মীয় প্রচারকরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতির জন্য রাজনীতিবিদদের “নাস্তিক” বলে থাকেন। তারা এই নেতাদের “মুরতাদ” (ধর্মত্যাগী), “নাস্তিক” এবং “ইসলামের শত্রু” বলেন। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা সকল গোষ্ঠীর জন্য সমান সম্মানের দাবি জানায়।
বাম রাজনৈতিক দলগুলো বুঝতে পেরেছে যে, তাদের মতাদর্শের প্রতি সত্য থাকার এবং প্রচলিত ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে আঘাত করা এড়ানোর মধ্যে একটি ভারসাম্য খুঁজে বের করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাগত স্বচ্ছতা দেওয়া এবং এটিকে বাংলাদেশমুখী করার পরিবর্তে, বেশিরভাগ বাম রাজনীতিবিদ নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে আওয়ামী লীগের ব্যবহার করা কৌশলটিই বেছে নিয়েছেন। ধর্ম বিরোধী অভিযোগগুলো আড়াল করার জন্য যেভাবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নিজেদের ধার্মিক হিসাবে তুলে ধরতেন, বামরা সেদিকেই এগিয়ে গেছেন।
এফজিডিতে প্রতিক্রিয়াগুলো বলে যে, মক্কায় পবিত্র হজ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বক্তৃতায় ইসলামিক নথির উল্লেখ করে নিজেদের ধার্মিকরূপে প্রকাশ বামদের কলঙ্ক মুছতে খুব বেশি কাজে দেয়নি। বরং, এই কৌশল এই ধারণা দেয় যে বামরা শুধুমাত্র রাজনৈতিক পয়েন্ট স্কোর করার চেষ্টা করছে। উদাহরণস্বরূপ, একজন উত্তরদাতা মন্তব্য করেছেন, “আমরা এই বাম দলগুলোকে দেখেছি, যেমন জাসদ এবং বাসদ, প্রতিবাদ বিক্ষোভ এবং সমাবেশে বামপন্থী শব্দভান্ডারের উপর নির্ভর করে। তবে, তারা যখন প্রকৃত রাজনীতিতে, মানে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তখন তারা ধর্মের কার্ডও খেলার চেষ্টা করে। আমরা দেখেছি হাসানুল হক ইনু থেকে রাশেদ খান মেনন পর্যন্ত বাম নেতারা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ধর্মীয় বিষয়গুলো উপস্থাপন করেছেন, এমনকি তাদের পোস্টারগুলিতে ‘আল্লাহ সবচেয়ে শক্তিশালী’-এর মতো ধর্মীয় বাক্যাংশ ব্যবহার করেছেন।”
অন্য একজন উত্তরদাতা আরও ব্যাখ্যা করেছেন যে, তাদের মূল আদর্শ মার্ক্সবাদ হতে পারে। কিন্তু তাদের মধ্যেও অন্যান্য দলের মতো সুবিধাবাদী প্রবণতা রয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তাই তারা ধর্মকে ব্যবহার করে তাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করে।
সংহতিমূলক সীমাবদ্ধতা: ইস্যু এবং সাংগঠনিক যোগসূত্রের অভাব
গত এক দশকে গ্রীস, পর্তুগাল এবং স্পেনে বাম দলগুলোর সাফল্য থেকে বোঝা যায়, সমমনা গোষ্ঠী এবং সুশীল সমাজের সঙ্গে যোগসূত্র ছোট দলগুলোকে সমর্থন জোগাতে সাহায্য করে।
এই সংযোগ বা যোগসূত্র দলগুলোকে নিজেদের পার্টি ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং দলীয় বার্তাগুলোকে শক্তিশালী করার বৈধতা প্রদান করে থাকে। নিজেদেরকে নির্বাচকদের দৃষ্টিতে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে এবং তৃণমূলে সংগঠিত করার জন্য বামদলগুলোর কাছে সুশীল সমাজের সংগঠন তৈরি, অনুপ্রবেশ এবং সহযোগিতা করার সুযোগ রয়েছে৷
ঐতিহাসিকভাবে, ট্রেড ইউনিয়নগুলো নাগরিক সমাজের অঙ্গনে বাম দলগুলোর সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র। যাইহোক, সামরিক শাসনের কারণে, যারা ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে দমিয়ে রেখেছিল, এই নাগরিক সমাজের সাথে বাম দলগুলোর যোগসূত্র ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে। দেশভাগের পর, ‘৬০ এর দশকে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের পাট ও বস্ত্র শিল্পগুলো বাম-আধিপত্যশীল শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর আবাসস্থল ছিল। শ্রমিক শ্রেণীর উপর নিয়ন্ত্রণ করতে এবং কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারণা চালাতে আয়ুব খান কারখানা-স্তরের ইউনিয়নবাদ চালু করেছিলেন। যা দুর্নীতিগ্রস্ত ইউনিয়ন নেতাদের উপকার করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও ট্রেড ইউনিয়নের রাজনীতিকরণ অব্যাহত ছিল। আওয়ামী লীগ প্রশাসন (১৯৭২-১৯৭৫) মূল শিল্পগুলোকে জাতীয়করণ করে এবং সমস্ত শ্রমিক ইউনিয়নকে একটি একক সংস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে।
সামরিক শাসন এই প্রবণতাকে দুভাবে বাড়িয়ে দেয়। প্রথমত, জিয়াউর রহমানের শাসনামল নিবন্ধিত সমস্ত রাজনৈতিক দলের জন্য নিজস্ব শ্রম ফ্রন্ট ঘোষণা করা বাধ্যতামূলক করে। এই পদক্ষেপটি ইউনিয়নের মধ্যে ভাঙনের সূচনা করেছিল এবং বাম দলগুলো শ্রমিক শ্রেণীতে তাদের আধিপত্য, নির্বাচনী এলাকা এবং সমাবেশের ভিত্তি হারিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, উত্তরসূরি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামল অর্থনীতির বেসরকারিকরণ তীব্রতর করে তোলে এবং ক্রমবর্ধমান বেসরকারি খাত ইউনিয়ন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ছিল। এটি ইউনিয়নবাদের মাধ্যমে বাম দলগুলোকে আরও সঙ্কুচিত করে তোলে।
সামরিক শাসন পরবর্তী যুগে, ট্রেড ইউনিয়ন বাংলাদেশের রাজনীতিতে মেরুকরণ শুরু করে। দুই বৃহৎ মধ্যপন্থী দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালাক্রমে দেশ শাসন করে। ক্ষমতায় থাকাকালীন, প্রতিটি দল শ্রমিক শ্রেণীকে নিজস্ব স্বার্থ সংগঠিত করতে না দিয়ে তাদের শ্রমিক ফ্রন্ট এবং ইউনিয়ন নেতাদের প্রচার করেছিল। এতদিনে বাম দলগুলো সাংগঠনিকভাবে এতটাই দুর্বল ছিল যে, এসব ইউনিয়নে তাদের উপস্থিতি বিএনপি ও আ’লীগের ক্ষমতার সাথে মেলাতে পারেনি। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ ফ্রন্ট বামদেরকে ছাড়িয়ে গেছে এবং বাম দলগুলো শ্রমিক অধিকার ও কল্যাণ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি এবং উপযুক্ত কাজের পরিবেশের বিষয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই দুর্বলতা বেদনাদায়কভাবে দৃশ্যমান হয়েছে।
যদিও বাম দলগুলো তাদের নির্বাচনী এলাকায় যথেষ্ট মনোযোগ দেয় না, এমন কথাও বলা যাবে না। বাম চারটি দলের অফিসিয়াল নথিগুলো ন্যূনতম মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের ওপর একটি বিশেষ ফোকাসসহ শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থার উন্নতির জন্য একটি স্পষ্ট অঙ্গীকার দেখায়। যাইহোক, ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতা দলগুলোর লক্ষ্য উপলব্ধি করাকে কঠিন করে তোলে।
একজন বাম নেতা বলেন, যদিও ট্রেড ইউনিয়নবাদ দালাল এবং ট্রেড ইউনিয়ন মাফিয়াদের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবুও বাম দলগুলো ইউনিয়নের মাধ্যমে কাজ করার চেষ্টা করছে। তার দৃষ্টিতে, বামরাও কারখানার শ্রমিকদের সংগঠিত করার দিকে মনোনিবেশ করছে না। যেহেতু গ্রামাঞ্চলে খেত-মজুর সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক-শ্রেণির মানুষ, তাই বাম দলগুলো তাদের জাল আরও বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে। তবে, তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে, বর্তমান বাংলাদেশে তৃণমূলের সংহতি আদর্শের চেয়ে কম। কোনো বাম নেতা আজো বিক্ষোভের মাধ্যমে তরুণ কর্মীদের প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হননি।
বাম দলগুলো ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সাথে দারিদ্র্য বিমোচন থেকে শুরু করে মানবাধিকারের উন্নতির লক্ষ্যে কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। দলগুলো এবং সুশীল সমাজের সংস্থাগুলো কীভাবে তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে তা নিয়ে তাদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে, ফলে তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সহযোগিতা খুব কমই আছে। রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের জন্য সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর শত্রুতার কারণেও তাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। একজন পাকা বাম রাজনীতিবিদ মন্তব্য করেছেন যে, সুশীল সমাজের সংস্থাগুলো রাজনৈতিক দলগুলোকে বাইপাস করে রাজনীতিকে “বিরাজনীতিকরণ” করার চেষ্টা করছে।
সেক্যুলার সমাজ নিয়ে গঠিত বেসরকারি এনজিওগুলোকে বামরা বিদেশী অর্থায়নে শক্তিশালী হয় বলে সন্দেহ করে থাকে। বাম দলগুলো সাধারণত এই সংস্থাগুলোকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পুতুল হিসাবে দেখে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির একাদশ পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবের নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি, উদাহরণস্বরূপ, ব্যাখ্যা করে কেন এনজিওগুলোকে সামাজিক সংস্কারে বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার হিসাবে দেখা হয় না।
“আজ দেশে এনজিওগুলো বড় ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছে। ব্যাপকভাবে বলতে গেলে, এনজিওগুলো একই সাম্রাজ্যবাদের জনবিরোধী নীতি দ্বারা সৃষ্ট দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং বেকারত্ব দ্বারা সৃষ্ট সামাজিক অস্থিরতা দূর করতে সাম্রাজ্যবাদেরই “নিরাপত্তা জাল” হিসাবে কাজ করছে। . . . দারিদ্র্য বিমোচনের নামে গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্রঋণ দিচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পগুলো উচ্চ সুদে ঋণ দিচ্ছে এবং তাদের কিস্তি পরিশোধের জন্য অন্য একটি এনজিও থেকে ঋণ নিতে বাধ্য করছে। গ্রামীণ জনগণ দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পরিবর্তে ঋণের দুষ্টচক্রে আটকা পড়ছে। তাই দেশে দরিদ্র, চাপগ্রস্ত, ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েছে। তবে ক্ষুদ্রঋণের এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এনজিওগুলো ব্যাপক মুনাফা করছে। এনজিওর সংস্কার কার্যক্রম স্বল্পমেয়াদে কিছু সুফল বয়ে আনছে অবশ্য। যদিও এই “সংস্কারের” বিরোধিতা করার কোন কারণ নেই, তবুও এই সংস্কারবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা আমাদের কর্তব্য। এনজিওগুলোর কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। তাই সব কিছু বিবেচনা করে বলা যায় যে, এনজিওগুলো নেতিবাচক এবং বিপজ্জনক অভিনেতা।”
একই কথা বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি তাদের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে তুলে ধরেছে। দলটি “ব্যবহারিক ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে গ্রামীণ মহাজন ও এনজিওদের ঋণের হাত থেকে কৃষক ও কৃষিকে বাঁচানোর” প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাম দল গণসংহতির নথিতেও এনজিওদের গরিব গ্রামীণ জনগণকে শিকার করা ঋণের হাঙর হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। দলটির ইশতেহারে সার, বীজ ও কীটনাশক বিক্রিকারী বহুজাতিক কোম্পানি এবং গ্রামীণ এনজিও ও মহাজনদের ঋণের ফাঁদ থেকে কৃষকদের বাঁচাতে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা উদীচী বা ছায়ানটের মতো সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে দেশের প্রকৃত সুশীল সমাজ হিসাবে উল্লেখ করে থাকেন। তারা এই সংগঠনগুলোর সাথে সহযোগিতার সম্ভাবনা দেখেন। বিশেষ করে রাজনীতি এবং সমাজের ডানপন্থায় ‘ঝুঁকে পড়া’ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে। বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেন যে, স্বৈরাচারী আমলে ইচ্ছাকৃত রাষ্ট্রীয় নীতি ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের দমন করে ইসলামের একটি রক্ষণশীল সংস্করণকে উন্নীত করেছিল।
ভাঙন বা বিভাজন
বিশেষজ্ঞরা বাম দলগুলোর দুটি বড় দুর্বলতা হিসেবে অন্তর্দলীয় দ্বন্দ্ব এবং অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাবকে সনাক্ত করেছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রতি বামদের সমর্থনে বিভক্তি দেখা দেয়। আজকের বাম রাজনীতিবিদরা জাতীয় রাজনীতির অমন মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারার জন্য অনুতপ্ত হচ্ছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে, সামাজিক বিপ্লবের উপযুক্ত রূপ নিয়ে বিতর্ক এবং দলীয় নেতৃত্ব নিয়ে ব্যক্তিত্বের সংঘাত দলগুলোর মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করে। ১৯৭৫ সালে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ সম্পর্কে একটি সুসংগত দৃষ্টিভঙ্গির অভাব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একজন প্রবীণ বাম রাজনীতিবিদ এখন কীভাবে বামপন্থীদের সম্মিলিত নীতি-আকৃতির শক্তি আরও কমেছে তার ব্যাখ্যা করেছেন:
“বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে বামরা কার্যত আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ে। তারা একটি শক্তিশালী স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে না কি কিছুটা ক্ষীণ আন্দোলনে যুক্ত হবে তা নিয়ে মতবিরোধের ফাঁদে পড়েছিল। . . . বাংলাদেশের প্রায় সকল বাম ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ পুরো দশকজুড়ে এই দ্বিধা/অনিশ্চয়তার শিকার হয়েছিল। তাদের কেউ এরশাদকে সমর্থন করেছিল আবার কেউ জিয়াকে সমর্থন করেছিল। কেউ কেউ দল ছেড়ে এরশাদের দলে যোগ দিয়েছেন। দিনশেষে, বামরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
বাম দলগুলো সামরিক শাসনের পরবর্তী সময়েও দলীয় রাজনীতির উত্তরাধিকার বহন করে এসেছে। কিছু বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন যে, দলীয় মতপার্থক্য এখন মূলত ব্যক্তিগত সংঘাত। তারা অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব, বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির অভাব এবং ব্যক্তিগত বিরোধগুলো জটিল হওয়ার কারণে দলগুলোতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় বলে জানিয়েছেন। যার ফলে দলগুলোর মধ্যে ফাটল ধরতে শুরু করে।
একজন বিশেষজ্ঞ ভিন্নমত পোষণ করে দাবি করেছেন, পুঁজিবাদী মিডিয়া বামদের মধ্যে বিভাজনকে আরও উস্কে দেয় এবং ভোটারদের কাছে তাদের দুর্বল হিসাবে তুলে ধরে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ দাবি করেছেন, এই বিভাজন দেশের বাম রাজনীতিকে তিন ভাবে প্রভাবিত করেছে: এটি তাদের ভোটারদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, জনশক্তি কিংবা টাকা পয়সা সবদিক থেকেই তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা হ্রাস করেছে এবং ক্ষমতায় থাকা কেন্দ্রবাদী দলগুলির তুলনায় ব্যক্তিগত এবং সম্মিলিত দর কষাকষির ক্ষেত্রে বাম দলগুলোর মূল্য কমে গেছে।
সামনে কী আছে?
বামরা তাদের রাজনৈতিক পুনরুদ্ধারে যে চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে সে সম্পর্কে অবশ্য ওয়াকিবহাল আছে। কমিউনিস্ট পার্টি থেকে আরও দেখা যেতে পারে:
“এত চেষ্টা ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টার পরও বাম ঐক্যের কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাম দলগুলোর প্রভাব ও গণসংহতি শক্তি অত্যন্ত দুর্বল। এছাড়া তাদের অনেকের অনেক ত্রুটি, বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি রয়েছে। বামদের একটি অংশ “মহাজোট” এর অংশীদার এবং তারা এখনো সরকারে আছেন। অন্যদিকে, কিছু বাম দল বিভিন্ন ধরণের দুর্বলতায় ভুগছে যেমন, বাম সাম্প্রদায়িকতা, বিপ্লবী শব্দগুচ্ছ, নিজেদের গণমানুষ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা ইত্যাদি। . . . এখন পর্যন্ত বামদের বাইরে কোনো দৃশ্যমান প্রভাবশালী, প্রগতিশীল, বৃহৎ, সৎ ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তি নেই যারা বামদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাম-গণতান্ত্রিক জোট গঠন করতে পারে।”
এই লেখার জন্য সাক্ষাত্কার নেয়া অনেক বিশেষজ্ঞই অদূর ভবিষ্যতে বামদের পুনরুত্থান সম্পর্কে আশাবাদী ছিলেন না। তাদের মধ্যে অনেকেই দেখেছেন যে, বাম মতাদর্শ দমিয়ে দেশে ইসলামি মতাদর্শ প্রাধান্য পেয়েছে এবং ডানপন্থী দলগুলোর বিরুদ্ধে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
আমরা একটি কার্যকর বিকল্প শক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি, যা আমরা চাই। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমনাধিকারের ন্যূনতম স্তরের জন্য আপনার যে ধরণের শক্তি প্রত্যাশা করেন, আমাদের কাছে তা নেই। আপনাদের সামাজিক গণতন্ত্র দরকার, যা এখানে নেই।
এক বাম নেতা তরুণ প্রজন্মের বাম মতাদর্শ গ্রহণে অনিচ্ছার জন্য হতাশা প্রকাশ করেছেন। তার দৃষ্টিতে, সমাজে ভোগবাদী সংস্কৃতির উত্থান এবং রক্ষণশীল ইসলামের ধর্মকর্মে শিথিলতা চলে আসায় এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে এ প্রজন্মের কাছে বাম মতাদর্শ অতটা আকর্ষণীয় নয়।
তবে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বর্তমানে এমন কোনো বাম দল আছে কিনা যারা তৃতীয় শক্তি হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, এ ব্যাপারে তারা ইতিবাচক কোনো জবাব দিতে পারেননি।
কিছু বাম রাজনীতিবিদ এবং সুশীল সমাজের ব্যক্তি জনগণের আর্থ-সামাজিক চাহিদার ভিত্তিতে একটি নতুন রাজনৈতিক এজেন্ডা তৈরির বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন। তারা ভেবেছিলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-প্রবণ দেশে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত অবনতি এমন একটি বিষয় হতে পারত যার উপর দাঁড়িয়ে বামরা সুসংগঠিত হতে পারত। গ্যাস এবং কয়লার মতো মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষা এবং প্রচারকে ইস্যু করেও তারা এগিয়ে যেতে পারত।
এমনকি সবচেয়ে আশাবাদী পর্যবেক্ষকরাও বামদের নেতৃত্ব গুণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কমরেডদের প্রতি এক বাম নেতার উপদেশ ছিল এরকম, “সংগঠন! সংগঠন! সংগঠন!” তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ও দৃশ্যমান হওয়া এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকে বামদের জন্য অপরিহার্য হিসাবে দেখেছেন। তবে বামদের বইপুস্তক বিশ্লেষণ করে দলগুলোর এই উপলব্ধি দেখা যায় যে, বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক থাকার জন্য তারা আদর্শিক এবং সাংগঠনিক শক্তির উপর জোর দিয়ে থাকে।
যাইহোক, প্রায় সকল বিশেষজ্ঞই একমত, বামদের কাজ করতে হলে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে পদ্ধতিগত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বামপন্থী এক বিশেষজ্ঞ বলছেন, “আমরা একটি কার্যকর বিকল্প শক্তি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি, যা আমরা চাই। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমনাধিকারের ন্যূনতম স্তরের জন্য আপনার যে ধরণের শক্তি প্রত্যাশা করেন, আমাদের কাছে তা নেই। আপনাদের সামাজিক গণতন্ত্র দরকার, যা এখানে নেই।”
তাহমিনা রহমান, ভিজিটিং সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রলিন্স কলেজ, ফ্লোরিডা।
নিবন্ধটি Carnegie Endowment for International Peace থেকে অনুদিত।
আপনার মতামত জানানঃ