‘রাম আর বাম’ দুই দলেরই মুখ পুড়লো পশ্চিমবঙ্গে। বিজেপির হম্বিতম্বি যেমন কাজে এলো না, তেমন মুখ থুবড়ে পড়েছে সিপিএম-সহ পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী দলগুলো। ৩৪ বছর পর এই প্রথম বিধানসভা থাকছে বামশূন্য। কোনও নির্বাচিত প্রতিনিধিই থাকছে না এবার বামদলগুলোর। যদিও ভোটের আগে আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রিগেড সমাবেশে ভিড় হয়েছিল বেশ। কিন্তু, ভোট বাক্সে আসেনি কোনও পরিবর্তন। উল্টো তাতে বাম-কংগ্রেসের আখেরে ক্ষতি হল কিনা, সেই প্রশ্ন জোরালভাবে উঠে আসছে।
এবার বৃদ্ধতন্ত্রের খোলস ঝেড়ে একঝাঁক নতুন মুখকে প্রার্থী করলেও, লাগাতার প্রচারের পরও তারা কেউই জিততে পারেনি। মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, ঐশী ঘোষ, সৃজন, সায়নদীপ, পৃথাদের নিয়ে চোখে স্বপ্ন বুনেছিল সিপিএম। কিন্তু কেউই লাইনটা টপকাতে পারলো না। উল্টে মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর বাম-কংগ্রেসের হাত থেকে পিছলে গেলো।
বামদের পতনের ইতিহাস
১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বামফ্রন্ট জোট পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে। ১৯৭৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ১০টা বিধানসভার নির্বাচন হলো। ২০১১ পর্যন্ত বামফ্রন্ট কখনো ৪০ শতাংশের কম ভোট পায়নি। অথচ এখন তাদের শতকরা ভোটের হার অর্ধেক হয়ে গেছে।
১৯৭৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সাতটি নির্বাচনে বামফ্রন্ট ২৯৪ আসনের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় কমবেশি ২০০ আসন পেয়েছে। ১৯৮৭ সালে সর্বোচ্চ ২৫১টি পেয়েছিল।
২০১১ থেকে তাদের বিপর্যয়ের শুরু ৬২ আসন পাওয়া দিয়ে। তবে তৃণমূল ঝড়েও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাননি বামপন্থীরা। বিধানসভায় পেয়েছিলেন ৬২টি আসন। কিন্তু তার পর সরকার বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে শক্তিবৃদ্ধি তো দূরের কথা, ২০১৬ সালের নির্বাচনে পেল ৩২টি আসন। শতকরা হিসেবে বামপন্থীদের প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ কমে গিয়ে দাঁড়ায় ২৬.১ শতাংশে।
এরপর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি রাজ্যের বামপন্থীরা। একটি আসনও তারা পাননি রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে। পেয়েছিলেন মাত্র ৭.৪৬ শতাংশ ভোট।
এ বার বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আর তৃণমূলের বিরোধিতা করেও তাদের ভোটের হার মাত্র ৫ শতাংশে পৌঁছতে পেরেছে। জেতেনি একটি আসনেও।
রাজনীতির চালেই ভুল ছিল বামেদের
পশ্চিমবঙ্গে বামেরা মুখ থুবড়ে পড়লেও ভারতের অন্যত্র কিন্তু ভিন্ন হাওয়া বইছে। বিহারেও কয়েক মাস আগের নির্বাচনে বাম দলগুলো অতীতের চেয়ে অনেক বেশি আসন পেয়েছিল। কেরালায় এবার আবারও ক্ষমতায় এসেছে বামেরা। কেরালায় এবার বামেরা শুধু যে জিতেছে তা-ই নয়, কোনো সরকারের পুনরায় নির্বাচিত না হওয়ার যে ইতিহাস আছে কেরালায়, সেটাও বদলে দিয়েছে।
তাই প্রশ্ন উঠেছে, বিহার কেরালায় বামেদের জয়রথ কেন বারেবারে গর্তে পড়ছে পশ্চিমবঙ্গে এসে?
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির নিয়ে আসা ধর্মবাদী রাজনীতি বদলে দিয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। হিন্দুপ্রধান একটি রাজ্যে হিন্দুত্ববাদকে যখন রাজনীতির হাতিয়ার করা হয়, তখন বামেরা নিজেদের শ্রেণি-রাজনীতি দিয়েই তাকে রুখতে চেয়েছিল। এখানে বিধি বাম বামেদের।
তবে সমাজে রুটিরুজিকে আঁকড়ে থাকা বামেরা না পারলেও, মমতার জাতীয়তাবাদীনীতি ঠিকই থামিয়ে দিল বিজেপিকে। বিশ্লেষকদের মতে এখানেই হেরে গেছে বামেরা। নিজস্ব ধ্যানধারণাকেই সঠিক ভেবে নিয়েই ছক সাজিয়েছিল বামপন্থীরা। কিন্তু তিন চালেই কিস্তিমাত। পাশাপাশি নিজেদের করেছে অপ্রাসঙ্গিক।
বাম নেতাদের এ অবস্থা দেখেই মমতা মাঝেমধ্যে রসিকতা করে বলে ওঠেন, ‘আমিই প্রকৃত লেফট’! পরিবর্তনকে চট করে বোঝার ক্ষমতা বাম-বুদ্ধিমত্তার একটা জরুরি শর্ত হলে মমতা আসলে ভুলে বলেন না।
পশ্চিমবঙ্গের বামেরা তাত্ত্বিকই রয়ে গেছে। সমাজে পুঁজিপতি ও শ্রমিক পরিচয়ের ভেতরে-বাইরে আরও অনেক ‘পরিচয়’ নিয়ে মানুষ বাঁচে। কিন্তু ‘মালিক’ ও ‘শ্রমিক’— এই দুই পরিচয়ের বাইরে এবারও ভোটার খোঁজেনি বামপন্থা। ফলে ভোটাররাও এই তাত্ত্বিকদের এড়িয়ে গেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ৩৪ বছরের অকর্মণ্যতা, ভ্রান্তি আর ঔদ্ধত্যের ইতিহাস সামনে রেখে এখন নীতিগত পরিবর্তন করলেও মানুষের বিশ্বাস অর্জনে ব্যর্থ হবে বামেরা। শ্রমিক কৃষিজীবীর মধ্যে আর লাল পতাকা কোনও আবেগের জন্ম দেয় না। তাছাড়াও গত এক দশকে অনেক বামপন্থীই হাতুড়ি ছেড়ে ত্রিশূল পদ্মফুলে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। হিন্দু বামেদের কেউ কেউ পূর্ববঙ্গীয় হিসেবে জেনেরিক্যালি ইসলাম বিদ্বেষী হয়েছে, আরেকদল ঠিক তার উল্টো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গরুর মাংস খেয়ে মুসলমানদের সাথে সংহতি জানিয়েছে। এই হিন্দুদের মধ্যে মার্ক্সকে কি আর ফিরিয়ে আনা যাবে? কে আনবে? গ্রামে, বস্তিতে, অভাবী মানুষের ঘরে গিয়ে স্বার্থহীন কাজ করার মত মানুষ কি আছে বামদলে? আর কাজ করলেও তাদের সামগ্রিক উন্নয়নে কি ভূমিকা রাখতে পারবে তারা নাকি এটাই বাংলায় বামেদের ‘দ্য এন্ড’?
আপনার মতামত জানানঃ