জার্মানির একটি রাজ্য লোয়ার স্যাক্সোনির ছোট্ট শহর শোনিঙ্গেন। মাত্র দশ-এগারো হাজার লোকের শহরে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে নির্মাণ করা হয়েছে শোনিঙ্গেন রিসার্চ মিউজিয়াম। প্রাগৈতিহাসিক বিষয়ে আগ্রহ আছে এমন লোকেরা প্রায়ই পা রাখে এখানে। কিন্তু কেন? কারণ শোনিঙ্গেনের এই মিউজিয়ামে নানা পুরাকীর্তির মধ্যে অন্যতম আটটি বর্শা, একত্রে যাদের বলা হয় শোনিঙ্গেন স্পিয়ার্স।
কী এই শোনিঙ্গেন স্পিয়ার্স? বলা হয়- মানুষের ব্যবহৃত কাঠের তৈরি শিকারের অস্ত্রের মধ্যে এই বর্শাগুলো প্রথম। বিশ্বে এখন পর্যন্ত কাঠের যত পুরাকীর্তি আছে, সেসবের মধ্যেও শোনিগেনের থেকে পুরনো কিছু এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্যালিওলিথিক বা প্রাচীন প্রস্তর যুগ, যে যুগের সমাপ্তি আজ থেকে দশ হাজার বছর আগে, সেই প্রাগৈতিহাসিক আমলের অস্ত্র এই বর্শা। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এদের খুঁজে পাওয়া গেছে শোনিঙ্গেনেই। এমন একটি জায়গা থেকে এগুলো উদ্ধার করা হয় যেখানে হাজার হাজার বছর ধরেই মানুষ ও পশুপাখির অবাধ পদচারণা ছিল বলে জানা যায়।
একসময় শোনিঙ্গেনের অধিবাসীদের জীবিকার উৎস ছিল শহরের অনতিদূরে কয়লা খনির কাজ। সেখানে ১৯৮২ সালে জার্মানির ইন্সটিটিউট ফর দ্য প্রিজার্ভেশন অব হিস্টোরিক্যাল মনুমেন্টস প্রত্নতাত্ত্বিক কাজের সম্ভাব্যতা নিয়ে জরিপ চালায়।
ফলাফল আশানুরূপ হলে অর্থ বরাদ্দ দেয় তারা। প্রাগৈতিহাসিক বিষয়ে অভিজ্ঞ প্রত্নতাত্ত্বিক ড. হার্টমুট থিয়েম ১৯৮৩ সালে দায়িত্ব পান প্রজেক্টের। মূল খননকাজ কিন্তু আরম্ভ হয় আরো পরে, ১৯৯৪ সালের দিকে।
থিয়েমই প্রথম ১৯৯৫ সালে আবিষ্কারটি করেন যেখানে বর্শাগুলো পাওয়া যায় সেই জায়গাটি। যেটি চিহ্নিত ছিল ১৩ নং সাইট হিসেবে। এখানে গবেষকরা প্রায় তিন-চার বছর কাজ করে অস্ত্রের পাশাপাশি কাঠের লাঠি এবং পশুর হাড়গোড়ও খুঁজে পান। হাড়গোড়ের মধ্যে ছিল গরু, হাতি আর গন্ডার জাতীয় প্রাণীর কঙ্কাল, এবং ঘোড়া ও বাইসনের দশ হাজারের বেশি হাড়।
রেডিওকার্বন ডেটিং ব্যবহার করা হয় প্রাচীনত্ব নির্ধারণের কাজে। ফলাফল অনুযায়ী শোনিঙ্গেন স্পিয়ার্সের বয়স ৩,৮০,০০০-৪,০০,০০০ বছর।
সাতটি বর্শা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল স্প্রুস (spruce) গাছের কাঠ, অন্যটিতে পাইন। লম্বায় এগুলো ছয় ফুট থেকে সাড়ে সাত ফুটের মধ্যে। তিনটি বর্শার গঠন দেখে মনে হয় সেগুলো ছুড়ে মারার জন্য তৈরি, চতুর্থ আরেকটি অস্ত্র খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যার জন্য।
এগুলোর নির্মাণকৌশল আসলেই চমকে যাবার মতো, অনেকটাই আধুনিক বর্শার কাছাকাছি। থিয়েমের মতে সেই সময়ের তুলনায় শোনিঙ্গেন স্পিয়ার্স হাই-টেক বলতে হবে।
থিয়েম ধারণা করেন, ১৩ নং সাইট প্রাগৈতিহাসিক যুগে শিকারের স্থান ছিল। অস্ত্রশস্ত্র, হাড়গোড় ইত্যাদি তার মতামতের পক্ষে জোরালো প্রমাণ। কিছু কিছু নিদর্শন দেখে এখানে নানা আচার অনুষ্ঠান পালন করা হতো বলেও মনে করেন গবেষকেরা। শিকারীরা এজন্যও শোনিঙ্গেন স্পিয়ার্স ব্যবহার করতো বলে মত আছে।
শোনিঙ্গেন স্পিয়ার্সের মতো ইংল্যান্ডের ক্ল্যাক্টন-অন-সি অঞ্চলে পাওয়া গেছে বর্শার ফলা। দুটো মিলিয়ে গবেষকরা সিদ্ধান্ত পোষণ করেন যে প্রাগৈতিহাসিক যুগে ব্যাপক আকারে শিকারীদের হাতে এসব অস্ত্র ছিল। বড় আকারের পশুপাখি শিকার করত তারা। ইংল্যান্ডে পাওয়া গেছে পাঁচ লাখ বছর আগের গন্ডার জাতীয় প্রাণীর ফসিল, যাতে বর্শার আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়।
শোনিঙ্গেন নিয়ে বিজ্ঞানীদের একটা তর্ক ছিল। এটা সত্যি যে কিছু কিছু বর্শা ছুড়ে মারার মতো করে তৈরি। তবে তখন পর্যন্ত তাদের জানামতে প্রাগৈতিহাসিক যুগে দূর থেকে শিকার করার প্রচলন ছিল না, শিকারকে ফাঁদে আটকে কাছ থেকে খুঁচিয়ে হত্যা করা হতো।
বিতর্ক নিরসনে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের একদল গবেষক একটি পরীক্ষার আয়োজন করেন। বর্শা ছুড়তে অভিজ্ঞ ছয়জনকে ডেকে আনেন তারা। শোনিঙ্গেন স্পিয়ার্সের যথাযথ রেপ্লিকা হাতে নিয়ে ছুড়ে মারেন তারা। বিশ মিটার পর্যন্ত দূরত্বে মোটামুটি নির্ভুলভাবেই নিশানা ভেদ করা গিয়েছিল।
ফলাফলের ভিত্তিতে সায়েন্টিফিক রিপোর্টস জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধে দাবি করা হয়- প্রাগৈতিহাসিক শিকারীরা বর্শা দ্বারা দূর থেকে শিকার করতে পারতেন। ছোটবেলা থেকেই তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হতো, সুতরাং বড় হতে হতে লক্ষ্যভেদে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করতেন তারা। অন্যতম গবেষক ম্যাট পোপের ভাষ্য, এই প্রযুক্তি যে তাদের হাতে ছিল এটা অভূতপূর্ব আবিষ্কার।
এসডব্লিউএসএস/১৯৪৫
আপনার মতামত জানানঃ