বিস্তৃত সমতল ভূমি ও বন্দরকে কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছে ভারী শিল্প-কারখানা। দেশের প্রথম ইপিজেডসহ আছে বেশ কয়েকটি শিল্পাঞ্চল। তবে আগের সেই কর্মচাঞ্চল্য এখন কমে এসেছে। নানামুখী সংকটে স্থবির হয়ে আসছে উৎপাদন কার্যক্রম। তাতে ভারী শিল্প খাতের গভীর সংকটে পড়তে যাওয়ারই ইঙ্গিত মিলছে।
এর মধ্যে ইস্পাত শিল্পের কাঁচামালের স্টক প্রায় ফুরিয়ে এলেও ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারায় নতুন করে চাহিদা অনুযায়ী আমদানির সুযোগ মিলছে না। একই কারণে ধুঁকছে নির্মাণ খাতের সিমেন্ট শিল্পও। রপ্তানি খাতে সংকটের মূল কারণটি আবার ভিন্ন।
নির্দিষ্ট ক্রেতা দেশের ওপর অতিনির্ভরতায় বিপদে পড়েছেন এ অঞ্চলের প্রথম সারির রপ্তানিকারকরা। মূলত ওইসব দেশে উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে চাহিদা অনুযায়ী ক্রয়াদেশ পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমান সংকট এতটাই তীব্র হয়েছে যে বন্ধ কিংবা সীমিত করে আনতে হয়েছে কারখানার উৎপাদন।
ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এমনিতেই তারা বড় ধরনের চাপে রয়েছেন। প্রতি টন রডের দাম লাখ টাকা ছুঁই ছুঁই, গত ডিসেম্বরেও যা ছিল ৮০ হাজার টাকার ঘরে। এর মধ্যে ডলার সংকটের কারণে প্রধান কাঁচামাল আমদানির সুযোগ সীমিত হয়ে আসায় ব্যবসা পরিচালনাই এখন বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
বর্তমানে চাহিদার ৫০ শতাংশ কাঁচামালেরও এলসি খুলতে পারছেন না বড় উদ্যোক্তারা। অথচ ইস্পাতের বড় কারখানাগুলোয় কমপক্ষে তিন মাসের মজুদ রাখতে না পারলে উৎপাদন কার্যক্রম ভেঙে পড়বে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম। প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চাহিদার মাত্র ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে পেরেছেন তারা। এরই মধ্যে কারখানায় রড উৎপাদন কমে গেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে একটা বড় ধরনের সংকটের আভাস মিলেছে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের কাছ থেকে।
এ প্রসঙ্গে বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, ব্যবসা পরিচালনায় এরই মধ্যে বড় ধরনের লোকসান গুনছি। উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, ১ লাখ ডলারের এলসি খুলতে লাগত ৮৬ লাখ টাকা, অবমূল্যায়নের কারণে এখন লাগছে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা।
অর্থাৎ ২৮ শতাংশ ফাইন্যান্স রিকয়্যারমেন্ট বেড়ে গেছে। এ ব্যয় বৃদ্ধিটা একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচও বেড়েছে ৩০ শতাংশের ওপর। তার পরও ঝুঁকি নিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সক্রিয় রয়েছি উৎপাদন সচল রাখতে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে সরকারের হয়তো উপায় নেই। কিন্তু এখন কাঁচামালই যদি আনতে না পারি ফ্যাক্টরি কীভাবে চালু রাখব? আমরা তো শিল্পের কাঁচামাল আনতে চাচ্ছি, বাণিজ্যিক পণ্য নয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা লিড টাইমের জন্য সবসময় চার মাসের স্টক রাখতাম। এখন এলসি খুলতে না পারায় খুব দ্রুতই স্টক জিরো হয়ে যাচ্ছে। এটি কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার আভাস। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খুলতে দেয়ার পাশাপাশি সরকারিভাবে ক্রয় অব্যাহত রাখা। আবার কারখানার চাকা ঘুরছে বিধায় অর্থনীতি এখনো সচল। তাই আগামী বাজেটে এনবিআরকেও এটা ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে।’
কাঁচামাল আমদানির বিষয়ে উদ্যোক্তাদের কথার সত্যতা মেলে এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষণেও। চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত জানুয়ারিতে পুরনো লোহার টুকরো (স্ক্র্যাপ) আমদানি হয়েছে আড়াই লাখ টনেরও কম। যদিও প্রতি মাসে চার লাখ টনের মতো স্ক্র্যাপের চাহিদা রয়েছে দেশে।
ইস্পাত শিল্পের কাঁচামালের দ্বিতীয় উৎস পুরনো জাহাজ। কাস্টমস তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এটির আমদানিও কমেছে অস্বাভাবিক হারে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধ হিসাব করলে জুলাই-ডিসেম্বরের এ ছয় মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পুরনো জাহাজ আমদানি হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৪৯৭ টন। এর আন্তর্জাতিক ক্রয়মূল্য ২ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে পুরনো জাহাজ আমদানি হয়েছিল ১১ লাখ ১৯ হাজার ১১২ টন, যার মূল্য ছিল ৫ হাজার ৮০২ কোটি টাকা।
অর্থাৎ পরিমাণের দিক থেকে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় পুরনো জাহাজ আমদানি কমেছে ৬৭ শতাংশ। এর মধ্যে গত ডিসেম্বরে আমদানি হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার ৭৫৫ টন, যেখানে আগের অর্থবছরের একই মাসে আনা হয়েছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার টন। সে হিসাবে এক মাসে ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত এ পণ্যের আমদানি কমেছে ৮০ শতাংশ।
ইস্পাত খাতের আরেক বড় প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম। কারখানা সম্প্রসারণের পর চট্টগ্রামভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতা এখন প্রায় ছয় লাখ টন। আগ থেকেই বাল্কে প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপ কিনে রাখায় তারা উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখতে পারছে।
তবে ইস্পাতের আরেক কাঁচামাল স্পঞ্জ আয়রনের রয়েছে ঘাটতি। এছাড়া অন্যান্য কাঁচামালও পর্যাপ্ত নেই বলে জানিয়েছেন কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত। তিনি বলেন, সংকট গভীর হতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে রডের কাঁচামালের স্টক ছোট হয়ে এসেছে।
অথচ কেউই স্বাভাবিকভাবে এলসি খুলতে পারছেন না। ফলে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম পড়ে যাওয়ার সুযোগটি নেয়া যাচ্ছে না। শিগগিরই আমাদেরও কাঁচামাল সংকটে পড়তে হবে। এখন যে স্টক আছে সেটাও দেড় মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তিন-চার মাসের স্টক রাখতে না পারলে পুরো সরবরাহ ব্যবস্থায় এর প্রভাব পড়ে।’
এদিকে সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, নির্মাণ খাতের পণ্যটি উৎপাদনে প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার, স্লাগ, লাইমস্টোন, ফ্লাই অ্যাশ ও জিপসাম সবই আমদানি করতে হয়। কিন্তু কাঁচামালের অভাবে তাদেরও উৎপাদন চালু রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাছাড়া চাহিদার তুলনায় সক্ষমতা দ্বিগুণের বেশি হওয়ায় প্রতিযোগিতা রয়েছে দাম নিয়েও। এ বিষয়ে প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সিমেন্টের ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বড় সংকট কাঁচামাল আনতে না পারা। এখন কোথায় গিয়ে যে দাঁড়াব।
এভাবে চলতে থাকলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের স্থবিরতা দেখা দেবে। বলা হচ্ছে খাদ্যপণ্য আমদানিতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অথচ আমরা ডেল্টা এগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত ব্যবসায় বড় বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু এক্ষেত্রেও এলসি খুলতে পারছি না।’
নানা সংকটে উৎপাদন বন্ধ কিংবা সীমিত করে আনছেন রপ্তানিতে যুক্ত বড় উদ্যোক্তারাও। কারণ তাদের হাতে তেমন ক্রয়াদেশ নেই। এমন পরিস্থিতিকে অর্থনীতির বিপদ হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। রপ্তানিতে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামভিত্তিক ইনডিপেনডেন্ট অ্যাপারেলস।
কাজ না থাকায় সম্প্রতি ১৮ দিনের জন্য পুরো উৎপাদন ব্যবস্থাই বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে তারা। ২৭ বছরের ব্যবসায় কখনই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম আবু তৈয়ব।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের এ সভাপতি বলেন, ‘আমি ১৮ দিনের জন্য পুরো উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করে কর্মীদের ছুটি দিয়ে দিয়েছি। কারণ হাতে কোনো অর্ডারই নেই। তবে কীভাবে পুনরায় শুরু করব কিংবা পরিস্থিতি কেমন থাকবে সেটি নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা। বড় বড় অনেক কারখানাই এখন একের পর এক উৎপাদন ইউনিট বন্ধ করে ছুটি দিয়ে দিচ্ছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত গড় হিসাব করলে ৩০ শতাংশ অর্ডারও নেই রপ্তানিকারকদের হাতে।’
এসডব্লিউএসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ