প্রতিদিন সাপের কামড়ে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্যর সংস্থা হিসেবে, বিষাক্ত সাপের দংশনে প্রতি বছর অন্তত ৮১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় শুধু।
সম্প্রতি এক গবেষণায় চমকপ্রদ এক তথ্য এসেছে, সব সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীরেই বিষ তৈরির জিনগত উপাদান আছে। মানুষের শরীরও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে সেটা সম্ভব হতে পারে শুধু উপযোগী বিবর্তনের মাধ্যমে।
সায়েন্স ফিকশনের গল্পে, পুরাণ বা নানা লোককথায় বিষকন্যা, বিষাক্ত মানুষের কথা আমরা শুনেছি। তাদের রক্তেই নাকি বিষ তৈরি হয়, কামড়ালেই নির্ঘাত মৃত্যু। তবে এসবই গল্প কথা। বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরাই বলছেন, মানুষও নাকি বিষ তৈরি করতে পারে। মানে বিষ তৈরির জন্য যে প্রক্রিয়া দরকার, তার প্রাথমিকটুকু মানুষের শরীরে আছে। বিবর্তনের ধারায় আগামী সময়ে মানুষও ভেনোমাস হয়ে উঠবে কিনা জানা নেই, তবে বিষ তৈরির যন্ত্রপাতি যে মানুষের শরীরে আছে তা জেনেই চমকে গেছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার বরাত দিয়ে ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে বলা, সমস্ত সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিষ তৈরির ‘টুল-কিট’ বা উপাদান আছে। কোনো সময় বিবর্তন হয়ে এমন ক্ষমতার স্ফূরণ হতে পারে, আবার নাও পারে।
জাপানের ওকিনাওয়া ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির বিবর্তনীয় জিনবিদ্যার পিএইচডির শিক্ষার্থী এবং অন্যতম গবেষক অগ্নিশ বড়ুয়া বলেন, মানবদেহে বিষ তৈরির উপাদান রয়েছে। এখন বিষ তৈরির ক্ষমতা পাওয়া বিবর্তনের উপর নির্ভর করছে।’
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, মানবদেহে লালা গ্রন্থিগুলির সঙ্গে যুক্ত একগুচ্ছ জিন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্বাধীন বিবর্তনের ধারায় অ-বিষাক্ত পূর্বসূরি থেকে বিষাক্ত উত্তরসূরি আসার ঘটনা শতবারের চেয়ে বেশি ঘটেছে।
মানুষ এখনো বিষ তৈরির ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। তবে অন্য অনেক প্রাণী অনেক দ্রুতই তা পেয়েছে। মাকড়সা, সাপ ও লজ্জাবতী বানরের মতো বিচিত্র প্রাণীর মধ্যে বিষের উপস্থিতি আছে।
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়নবিদ ও বিষ বিশেষজ্ঞ ব্রায়ান ফ্রাই এই গবেষণা নিয়ে বলেন, ‘এই গবেষণা একটি বিশাল অর্জন। গবেষকেরা একটি অসাধারণ কাজ করেছে।’
গবেষণা থেকে জানা যায়, কোবরা বা র্যাটল স্নেকের মতো মানুষ বিষ উগড়ে দিতে পারবে না। তবে বিষাক্ত কিছু প্রোটিন তৈরি হয় মানুষের শরীরেই। সেটা কেমন?
জাপানের ওকিনাওয়া ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ভারতীয় গবেষক অগ্নীশ বড়ুয়া বলছেন, মানুষের শরীরে এমন কিছু জিন আছে যারা এই প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে পারে। তার মানে এমন নয় যে এইসব জিন থেকে টক্সিক উপাদান তৈরি হচ্ছে। আসল ব্যাপারটা হল, বিষ তৈরির জন্য যে মেকানিজম দরকার সেটা চালনা করতে পারে এইসব জিন। বিজ্ঞানের ভাষায় ভেনোম সিস্টেম-এর দেখাশোনা করতে পারে এই জিনগুলি।
আরও সহজ করে বলা যাক। এই যে সাপ, কয়েক প্রজাতির মাকড়সার মধ্যে বিষ থাকে তা তৈরি হয় ওরাল ভেনোম গ্ল্যান্ড থেকে। ওই ওরাল ভেনোম গ্ল্যান্ড হল আরও পরিবর্তিত স্যালিভারি গ্ল্যান্ড। থুতুর মধ্যে মিশে যায় বিষাক্ত প্রোটিন। সেই থুতু বা কষ শরীরে ঢুকলে স্নায়ুর দফারফা করে ফেলে।
অস্ট্রেলিয়া কুইনসল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট ব্রায়ান ফ্রাই বলছেন, এই গবেষণার এটাই হল ল্যান্ডমার্ক। যত ঘটনার ঘনঘটা ওই ওরাল স্যালিভারি গ্ল্যান্ডেই। মানুষের থুতুতে একরকম প্রোটিন বের হয় যার নাম কাল্লিক্রেইনস। এই প্রোটিন অন্যান্য প্রোটিনগুলোকে গিলে ফেলতে পারে। মানে নষ্ট করে দিতে পারে। এই প্রোটিন বিষ তৈরির অন্যতম উপাদান হতে পারে।
গবেষক বড়ুয়া বলছেন, এই প্রোটিনের যদি মিউটেশন শুরু হয় তাহলে এমন বিষ তৈরি করতে পারে যা খুবই যন্ত্রণাদায়ক এবং প্রাণঘাতী। গবেষক আরও বলছেন, প্রাণীজগতে যত ভেনোমাস জীব আছে তাদের বিষের অন্যতম উপাদান এই প্রোটিন। কারণ কাল্লিক্রেইন খুবই সক্রিয় এনজাইম। তাই মানুষকে যদি সাপের মতো ভেনোমাস হতে হয়, তাহলে এই প্রোটিন প্রাথমিকভাবে দরকার।
এখন ভেনোমাস আর পয়জনাসের মধ্যে কিন্তু পার্থক্য আছে। যে সব প্রাণীর কামড়ে বিষ শরীরে ঢোকে তারা ভেনোমাস। আবার যে সব প্রাণীকে খেয়ে ফেললে তাদের শরীরে সঞ্চিত বিষ আমাদের শরীরে ঢুকে যায় তারা পয়জনাস।
সাপের বিষ তৈরি হয় তাদের ওরাল ভেনোমাস গ্ল্যান্ডে। সাপের চোয়ালের ঠিক পেছনে থাকে বিষথলি। আগেই বলেছি এই বিষথলি হল লালাগ্রন্থি বা স্যালিভারি গ্ল্যান্ডের পরিবর্তিত রূপ। এখানেই তৈরি হয় বিষাক্ত প্রোটিন যা লালার মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। সব সাপের বিষে যে একরকম উপাদান থাকে তা নয়, বিভিন্ন প্রজাতির সাপের বিষ বিশ্লেষণ করে শতাধিক যৌগের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
সাপের বিষে থাকে প্রোটিন, এনজাইম (ট্রান্সফারেজ, হাইড্রোলেজ ও অক্সিডোরিডাকটেজ)। এই বিষ প্রাণঘাতী বটে, তবে স্বল্প মাত্রায় বিষের প্রয়োগ হলে শরীরের ইমিউনিটি বাড়ে। এর কারণই হল ওই সক্রিয় এনজাইমগুলোর উপস্থিতি।
গবেষকরা বলছেন, এই নতুন গবেষণার উদ্দেশ্যও তাই। মানুষকে ভেনোমাস করে তোলা বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য নয়, বরং এই বিষ তৈরির প্রক্রিয়া এবং কোন কোন জিন এই প্রক্রিয়ার পেছনে আছে তা জানতে পারলে অনেক দুরারোগ্য ব্যধির চিকিৎসা সম্ভব হবে।
যেমন ভ্যামপায়ার বাদুড়দের বিষাক্ত লালা ব্লাড ক্লট রুখতে পারে। যে কোনও ক্ষত নিরাময়ে এই সেই লালা কাজে আসে। সাপের বিষকে কাজে লাগিয়ে ওষুধ তৈরির পদ্ধতি বহুকাল থেকেই আছে আমাদের দেশে।
কাজেই মানুষের মধ্যেও যদি বিষ তৈরির যন্ত্রপাতি থাকে তাহলে সেটিকে মানুষের উপকারের কাজেই লাগানো যেতে পারে। তার জন্য সেই বিশেষ জিনগুলোকে খুঁজে বের করছেন বিজ্ঞানীরা। এই জিনের কারসাজি ধরে ফেললেই অনেক মারণ রোগের প্রকোপ থেকেও জীবন ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে।
এসডব্লিউএসএস/১৬৪৫
আপনার মতামত জানানঃ