কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে মানবিক আশ্রয়েকেন্দ্র থাকা রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় দ্বিতীয় দফায় নোয়াখালীর ভাসানচরে যাওয়ার পথে। সোমবার (২৮ ডিসেম্বর) দুপুর পৌনে ১২টার দিকে চট্টগ্রামের পথে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করে ১৩টি বাস। এরপর বেলা ৩টার দিকে আরও ১০টি বাস রওনা দেয়।
আগের মতো উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠ এলাকা থেকে তিন দলে ভাগ করে বাসগুলো চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছাড়ে। উখিয়ার মূল ক্যাম্প ছাড়াও পুরো ৩৪ ক্যাম্প থেকেই ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গারা ট্রানজিট পয়েন্টে আসতে শুরু করেছে গতকাল রবিবার বিকেল থেকে। বাকিরা সোমবার সকাল ও দুপুরে এসে পৌঁছায়। আগেরবার রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিতে অনেক বোঝাতে হলেও ২০ দিনের মধ্যে পাল্টেছে চিত্র। এবার রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে নিজেরাই তালিকায় নাম লিখিয়েছে।
জানা যায়, যারা স্বেচ্ছায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভাসানচরে যাবার, কেবল তাদেরই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এর ফলে ১০ লক্ষের’ও বেশি রোহিঙ্গাদের আবাসস্থলের ভিড় কমে আসছে। আরো জানা যায়, দ্বিতীয় দফায় ১৭ শর বেশি রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দ্বিতীয় দফায় ৭০০ রোহিঙ্গা স্থানান্তরের পরিকল্পনা থাকলেও, এর দ্বিগুণের বেশি রোহিঙ্গা সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বেচ্ছায় কক্সবাজার থেকে ভাসানচরের দিকে যাচ্ছেন। মঙ্গলবার দুপুর নাগাদ এই রোহিঙ্গারা ভাসানচরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। গতবারের মতো এবারও র্যাব-১৫ এবং অন্যান্য শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে।
দ্বিতীয় দফার এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রোহিঙ্গা স্থানান্তর নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিরোধিতাকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারের প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ায় সরকার ভাসানচরে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে। যারা ইতোমধ্যে ভাসানচরে গিয়েছে, তারা আনন্দ উল্লাস-স্বস্তি প্রকাশ করলেও কোনো কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বহুজাতিক গণমাধ্যম রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে জোরপূর্বক স্থানান্তরের কথা প্রচার করছে, যা আদৌ সত্য নয়।
জানা যায়, নোয়াখালীর হাতিয়ায় সাগরের মাঝে ভেসে থাকা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা সংবলিত ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে। বসবাসের যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তা দেখতে গত সেপ্টেম্বরে দুই নারীসহ ৪০ রোহিঙ্গা নেতাকে সেখানে নিয়ে যায় সরকার। তারা ভাসানচরের আবাসন ব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ হয়। তারা ক্যাম্পে ফিরে অন্যদের ভাসানচরে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। দু’বছর আগে সরকার ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তাদের অনিচ্ছার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে এর যাত্রা শুরু হওয়ায় উখিয়া-টেকনাফের সাধারণ মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করছেন।
ভাসানচরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের অনেকে জানান, তারা ভাসানচর পরিদর্শন শেষে ফিরে আসা রোহিঙ্গা নেতাদের মুখে সেখানকার বর্ণনা শুনে এবং প্রথম দফায় যাওয়া রোহিঙ্গাদের দেয়া অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেখানে যেতে রাজি হয়েছেন। তাদের মতে পাহাড়ের ঘিঞ্জি বস্তিতে বসবাসের চেয়ে ভাসানচর অনেক নিরাপদ হবে। এ ছাড়া ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য নির্মিত অবকাঠামো অনেক বেশি আধুনিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে বলে মনে করছে রোহিঙ্গারা।
এর আগে ডিসেম্বরের ৪ তারিখে এক হাজার ৬৪৫ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার আপত্তির মধ্যেই তখন ওই রোহিঙ্গাদের প্রথমে বাসে করে চট্টগ্রামে নেয়া হয়, এরপর সেখান থেকে তাদের নৌবাহিনীর জাহাজে করে ভাসানচরে পাঠানো হয়।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নিপীড়নের মুখে দেশটি থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ওই বছরের নভেম্বর মাসে কক্সবাজার থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেয়ার জন্য একটি প্রকল্প নেয় সরকার। আশ্রয়ণ-৩ নামে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে। কিন্তু ২০১৮ সালে যখন প্রথম তাদের স্থানান্তরের পরিকল্পনা করা হয়, তখন থেকেই রোহিঙ্গারা সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছিল।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১১৫
আপনার মতামত জানানঃ