নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপির বিভাগীয় ধারাবাহিক সমাবেশের অংশ হিসেবে ১০ ডিসেম্বর যে সমাবেশটি ঢাকায় ডাকা হয়েছে, সেই সমাবেশ ঘিরে রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে বুধবার নয়াপল্টন হয়ে ওঠে রণক্ষেত্র। নয়াপল্টন জুড়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছে এখনও। জড়ো হচ্ছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। বিএনপি কার্যালয় ঘিরে রেখেছে পুলিশ। নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করে মুঠোফোন পরীক্ষা করছে পুলিশ।
আগামীকাল ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বেশ বেড়ে গেছে। রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোতে গত বুধবার থেকে তল্লাশিচৌকি বসিয়েছে পুলিশ।
এসব জায়গায় পুলিশ সাধারণ মানুষকে তল্লাশির নামে হয়রানি করছে বলে অভিযোগ এসেছে। এ সময় কারও কারও মুঠোফোন পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। এতে কী ধরনের ছবি ও বার্তা আছে—পুলিশকে সেগুলো যাচাই করতে দেখা গেছে। এভাবে বাছবিচারহীন তল্লাশি ও মুঠোফোন পরীক্ষা আইনসংগত কি না, এখন সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
গত বুধবার দুপুরে টঙ্গী সেতু হয়ে ছেলে মো. অনিককে (১৫) নিয়ে মোটরসাইকেলে করে রাজধানীর মিরপুরে যাচ্ছিলেন মো. পলাশ। সেতুর সামনে আসতেই তাঁদের থামায় পুলিশ। প্রথমে দুজনের দেহ তল্লাশি করা হয়। পরে ব্যাগ তল্লাশি ও মুঠোফোনের ছবি ও বার্তা যাচাই করে দেখা হয়।
একপর্যায়ে তাদের আটক করলে কাকুতিমিনতি করে ছাড়া পান তারা। পলাশ বলেন, ‘আমি সাধারণ শ্রমিক। কোনো দলের রাজনীতি করি না। তারপরও পুলিশ আমাদের এভাবে হয়রানি করল।’
পুলিশের পক্ষ থেকে অবশ্য এ ধরনের তল্লাশিকে নিয়মিত কাজের অংশ বলে দাবি করা হয়েছে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, পুলিশ তল্লাশি চালাতেই পারে। তবে তাদের কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। গত বুধবার তারা যেভাবে তল্লাশি চালিয়েছে, তাতে এসব শর্ত মানা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘চলাফেরার অধিকার আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। পুলিশ তল্লাশির নামে এই অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে না। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে কোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি করতে হলে যুক্তিসংগত সন্দেহ থাকতে হয়। এর অর্থ, বাছবিচারহীন তল্লাশি চালানোর ক্ষমতা পুলিশের নেই। এটা উচ্চ আদালতের নির্দেশনারও পরিপন্থী।’
কেউ কেউ অভিযোগ করেন, পুলিশ তাদের পথ আটকে দেহ তল্লাশি ছাড়াও মুঠোফোনের ছবি ও বার্তা ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। এটা ছিল তাদের জন্য চরম বিব্রতকর ও হয়রানির বিষয়।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, মুঠোফোনে মানুষের ব্যক্তিগত ও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, তথ্য বা ছবি থাকতে পারে। তল্লাশির সময় পুলিশ সেগুলো দেখতে পারে না। এটা ব্যক্তির গোপনীয়তাকে ক্ষুণ্ন করেছে। গোপনীয়তা ব্যক্তির সংবিধানস্বীকৃত একটি অধিকার। তাই পুলিশের এ ধরনের কর্মকাণ্ড সংবিধান ও আইনসংগত নয়।
ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশমুখে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ গত দুই দিনে কতজনকে আটক বা গ্রেপ্তার করেছে, সেই তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে এ ধরনের তল্লাশি সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাপক ভোগান্তি ও হয়রানির কারণ হচ্ছে, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে এটা স্পষ্ট।
এবারই প্রথম নয়, এর আগেও পুলিশ এমন বাছবিচারহীন দেহ তল্লাশি এবং মুঠোফোন পরীক্ষা করেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তারা রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় চৌকি বসিয়ে তল্লাশির নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করেছে।
মানুষ আশা করে, আইনসংগত নয় এবং মানুষের ভোগান্তি ও হয়রানির কারণ হবে, এমন কর্মকাণ্ড থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরত থাকা উচিত।
‘আতঙ্কে’ ঢাকামুখী হচ্ছে না মানুষ
ঢাকায় বিএনপির ডাক দেওয়া গণসমাবেশের আগে রংপুর থেকে ঢাকামুখী বাসগুলোতে যাত্রীসংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে এই রুটে চলাচলকারী বাসের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন মালিকেরা।
বিশিষ্ট নাগরিকেরা বলছেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশের আগে সৃষ্ট অবস্থায় জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এ কারণে জরুরি কাজ না থাকলে কেউ ঢাকামুখী হচ্ছেন না।
আজ শুক্রবার সকালে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের মডার্ন মোড়, কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট মহাসড়কের মাহিগঞ্জ সাতমাথা, দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড়-নীলফামারী মহাসড়কের মেডিকেল মোড়, নগরের কামারপাড়া ঢাকা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মহাসড়কগুলোতে আন্তজেলার বাস চলাচল স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ঢাকাগামী বাসের সংখ্যা কমে গেছে।
প্রতিটি কোম্পানি আগে এক ঘণ্টা পরপর বাস ছাড়লেও এখন তিন ঘণ্টা পর পর ছাড়ছে। এতেও পর্যাপ্ত যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পরিবহন কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপকেরা।
যাত্রী কমে যাওয়ার পেছনে দুটি কারণের কথা বলেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি খন্দকার ফখরুল আনাম। তিনি বলেন, বিএনপির এই সমাবেশের আগে রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূতভাবে এই যে কয়েক দিন ধরে বলা ‘খেলা হবে’, ‘খেলা হবে’ এতে করে জনমনে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এ জন্য খুব জরুরি না হলে মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছেন না।
অন্যদিকে পুলিশের ভূমিকাও বেশ নেতিবাচক। মহাসড়কে যানবাহন থামিয়ে সাধারণ যাত্রীদের যেভাবে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানি করা হচ্ছে, তাতে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। এসব এড়াতেই মানুষ এখন ঢাকার দিকে কম যাচ্ছে।’
ভিডিও করায় গ্রেপ্তার
রাজধানীতে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের আগের দিন নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে ফেসবুক লাইভ দিয়ে আটক হয়েছেন এক ছাত্রদল নেতা ও এক পোশাক কারখানার কর্মী। তাদেরকে ধরা হয় উসকানিমূলক বক্তব্য ছড়ানোর অভিযোগ এনে, যদিও তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কী অভিযোগ, তা জানানো হয়নি।
আটক ছাত্রদল নেতার নাম আব্দুল্লাহ আল রবিন। তিনি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক বলে জানিয়েছে পুলিশ। পোশাক কর্মীর নাম রহমত উল্লাহ। তিনি কোনো দল করেন না বলে দাবি করছিলেন।
ছাত্রদল নেতাকে আটক করে সাদা পোশাকের পুলিশ আর পোশাক কর্মীকে আটক পুলিশের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের কর্মকর্তারা। তাদেরকে পল্টন থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
ছাত্রদল নেতাকে যখন বাইকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তিনি জোরে জোরে দুই হাত তুলে বলছিলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই, খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই।’
মতিঝিল বিভাগে সহকারী পুলিশ কমিশনার গোলাম রুহানী বলেন, ‘রবিন কার্যালয়ের সামনে এসে ফেসবুকে লাইভে গিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য ছড়াচ্ছিল। এ কারণে তাকে আটক করা হয়।’
তবে ছাত্রদল নেতা-কী বলেছিলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি পুলিশ। ছাত্রদল নেতার সঙ্গেও কথা বলা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে তিনি বিভাগীয় সমাবেশে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছেন।
কিছুক্ষণ পর একই অভিযোগে আটক হন রহমত উল্লাহ নামে দ্বিতীয় জন। তাকে পুলিশ ভ্যানে করে পল্টন থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আটক করার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলছিলেন, ‘আম কোনো দল করি না।’
পুলিশের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের একজন উপকমিশনার বলেন, ‘রহমত ফেসবুকে লাইভ করতে করতে কার্যালয়ে দিকে যাচ্ছিলেন। লাইভে উসকানিমূলক বক্তব্য ছিল। তিনি এই এলাকার পরিস্থিতি দেখাচ্ছিলেন।’
বিএনপি কার্যালয় ঘিরে পুলিশ
রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির প্রধান কার্যালয় তৃতীয় দিনের মতো ঘিরে রেখেছে পুলিশ। দলটির কোনো নেতা-কর্মীকে দেখা যায়নি কার্যালয় এলাকায়।
শুক্রবার সকালে নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়, কাকরাইল মোড় ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় একই ধরনের চিত্র দেখা যায়। ছুটির দিন হওয়ায় সাধারণ মানুষকেও রাস্তায় সেভাবে দেখা যায়নি। রাস্তায় বাস ও রিকশা চলাচল কম, নেই গণপরিবহনে ভিড়।
নাইটিঙ্গেল মোড় ও ফকিরাপুল মোড়ের রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছে পুলিশ। এ দুই মোড়ের মধ্যবর্তী জায়গায় কোনো যান চলাচল করতে দেয়া হচ্ছে না। এই অংশে সব দোকানপাটও বন্ধ রয়েছে। ওই এলাকায় কোনো সাধারণ মানুষকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। তাদের অন্য এলাকা দিয়ে যেতে বলা হচ্ছে।
নয়াপল্টনে জড়ো হচ্ছে বিএনপি
বিএনপির সমাবেশে যোগ দিতে দলটির নেতা-কর্মীরা রাজধানীর নয়াপল্টন কার্যালয়ের দিকে আসছেন। তবে পুলিশের বাধায় বেশিদূর যেতে পারেননি তারা।
একদিন পরেই সমাবেশ হওয়ায় শুক্রবার সকাল থেকেই নয়াপল্টনে দলের তৃণমূল ও সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা আসছেন। গণমাধ্যমকে কয়েকজন নেতা-কর্মী বলেন, সকালে নয়াপল্টনে এসেছেন তারা। তবে পুলিশের বাধার কারণে নাইটিঙ্গেল মোড়েই তাদের থেমে যেতে হয়।
সিরাজগঞ্জ থেকে আসা ছাত্রদলের এক কর্মী জানান, তারা বুধবারই নয়াপল্টনে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা ফের শুক্রবার সকালে নয়াপল্টনে এসেছেন।
টঙ্গী মাজুখান থেকে বিএনপি কর্মী সোহাগ নয়াপল্টনে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি নয়াপল্টনে এসেছি। কিন্তু আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না।’ সোহাগ বলেন, ‘আমরা ১৫-২০ জন মিছিল নিয়ে আসার সময় আমাদের সঙ্গে থাকা একজনকে আটক করেছে পুলিশ। তখন গলিতে ঢুকে গেলে অন্যদের আর ধরতে পারেনি পুলিশ।’
নেত্রকোনা থেকে নয়াপল্টনে এসেছেন ছাত্রদলের এক নেতা। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে বার্তা আছে, আমরা এখানেই সমাবেশ করব।’
এসডব্লিউএসএস/১৪৪০
আপনার মতামত জানানঃ