বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। এই রাজ্যের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের কার্যালয় রয়েছে। হাইকমিশন থেকে ১১ অক্টোবর ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পাঠানো বিভিন্ন পণ্যের একটি বিরাট অংশের ‘পেমেন্ট’ বা মূল্য পরিশোধে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মাদক।
প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, প্রতিবেদনটির ভিত্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৭ অক্টোবর একটি চিঠি দিয়ে মাদক-বাণিজ্যের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের আটটি সংস্থাকে জানায়। সর্বশেষ ১৯ অক্টোবর সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি উত্থাপন করা হয়।
‘ত্রিপুরার মাদক-বাণিজ্য’ নিয়ে আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদক চোরাচালানের জন্য ত্রিপুরা একটি ‘করিডর’। এই করিডর ব্যবহার করে ইয়াবা, হেরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক মিয়ানমার থেকে ভারতের মিজোরাম ও আসাম হয়ে ত্রিপুরায় পৌঁছায়। এর পর সেখান থেকে এসব মাদক বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের কার্যালয় সূত্র বলছে, ত্রিপুরায় পণ্য আমদানি-রপ্তানির আড়ালে মাদকের কারবারও চলছে। আর কাজটি হচ্ছে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে গিয়ে অর্থাৎ হুন্ডিতে লেনদেনে মাধ্যমে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ৮ অক্টোবর ভারতের আসামের গুয়াহাটিতে ‘রিজওনাল মিটিং অন ড্রাগ ট্রাফিকিং অ্যান্ড ন্যাশনাল সিকিউরিটি’ শীর্ষক বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা মাদক-বাণিজ্য নিয়ে কথা বলেন।
মাদক চোরাচালানের ক্ষেত্রে ত্রিপুরা করিডর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেন। ত্রিপুরায় মাদক ব্যবসার তিনটি ধরনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা মাদক ত্রিপুরা হয়ে বাংলাদেশে যায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী তার ওই বক্তব্যে আরও বলেছেন, ২০০০ সাল থেকে ত্রিপুরায় ‘অকল্পনীয় পর্যায়ে’ গাঁজার চাষ হচ্ছে। এই মাদক বাংলাদেশসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যাচ্ছে। মাদক চোরাচালান বন্ধে ২০১৮ সাল থেকে ত্রিপুরা সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও জানান তিনি। এ ছাড়া সীমান্তে মাদক চোরাচালান বন্ধে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে শক্তিশালী করা এবং বাংলাদেশের সঙ্গে নিয়মিতভাবে আলোচনা করা বিশেষভাবে প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ত্রিপুরায় পণ্য আমদানি-রপ্তানির আড়ালে মাদকের কারবারও চলছে। আর কাজটি হচ্ছে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে গিয়ে অর্থাৎ হুন্ডিতে লেনদেনে মাধ্যমে।
সহকারী হাইকমিশনের কার্যালয়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ইয়াবা ট্যাবলেটের মূল উৎস মিয়ানমার, যা কক্সবাজার জেলাসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে বেশি প্রবেশ করে থাকে। ওই অঞ্চলে বাংলাদেশে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার কারণে মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের রুট পাল্টে মিয়ানমার-মণিপুর-ত্রিপুরা-বাংলাদেশ ও মিয়ানমার-মিজোরাম-আসাম-ত্রিপুরা-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচার করছে।
পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, ত্রিপুরা রাজ্যর সাবেক মুখমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ও বিএসএফের (ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) মধ্যকার বাহ্যিক দূরত্ব থাকলেও মাদক চোরাচালানের সময় কেন জানি সবাই এক হয়ে যায়।’
এদিকে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা-আইসসহ যেসব মাদক দেশে ঢোকে তার বেশির ভাগই আনা হয় বাকিতে। আগে এ জন্য কোনো কিছু বন্ধক রাখতে হতো না। এখন বন্ধক কিংবা জিম্মা দিয়ে আনতে হয় চালান। বন্ধক হিসেবে রাখা হয় মানুষ। কোনো কারণে চালানের টাকা পরিশোধ না হলে এই বন্ধকি মানুষটির লাশ পড়ে নাফ নদীতে।
সম্প্রতি টেকনাফের স্থানীয়দের বন্ধক রেখে দেশে মাদকের চালান আনার বেশ কয়েকটি অভিযোগ উঠেছে। নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধ না করায় বন্ধক রাখা মানুষদের ওপর নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের এমন পন্থায় রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মাদক প্রতিরোধে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে ইয়াবা-মাদকের উৎপাদন বেড়েছে। সেই সঙ্গে এই মাদক ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকার ধারাবাহিকভাবে কঠোর অভিযান চালালেও মাদক থেকে বাঁচানো যাচ্ছে না দেশের যুবসমাজকে। জিরো টলারেন্স নীতি নেয়ার কারণে ওই সব অভিযানে মাদক কারবারিদের অনেকে প্রাণ হারিয়েছে। তার পরও এর বিস্তার রোধ করা যায়নি। বরং দেশে নতুন নতুন মাদকের দেখা মিলছে। এসব মাদক আগেরগুলোর চেয়ে আরো ভয়াবহ।
লক্ষণীয়, দেশে যতই কড়াকড়ি আরোপ করা হোক না কেন, এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সীমান্তের হাজার হাজার কিলোমিটার পথ যদি মাদক পাচারে ব্যবহৃত হয়, আর সেখানেই যদি গড়ে ওঠে মাদকের কারখানা; তাহলে আমাদের দেশের তরুণ-যুবকদের মাদকের হাত থেকে রক্ষার কোনো উপায় থাকে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৭
আপনার মতামত জানানঃ