সরকারের মেয়াদ শেষ প্রান্তে চলে এলেও নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী নিরাপদ সড়কের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ কারণেই সড়কে প্রতিদিন অসংখ্য প্রাণহানি ঘটছে। পাশাপাশি হাজার হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছেন।
জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ২০২২’ উপলক্ষে শুক্রবার (২১ অক্টোবর) রাজধানীর পল্টনে বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এ কথা জানান।
সড়ক পরিবহন আইনানুযায়ী দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া ও জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল সক্রিয় করার দাবি’তে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সরকারি হিসেবে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ৩৬০ জনের মৃত্যু ছাড়াও প্রায় ৮০ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছেন।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী— প্রতিবছর সড়কে প্রায় ৮ হাজার মানুষের প্রাণহানির ও ৮০ হাজার মানুষের পঙ্গুত্ব বরণ করার তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে ১৭ বছরের কম বয়সী শিশু ১২ হাজারের বেশি।
সংগঠনটি জানায়, এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছেন কেবল সড়ক দুর্ঘটনায়। অন্যদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বলছে— বিশ্বে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে ২৪ হাজার ৯৫৪ জন।
সংস্থাটি দাবি করছে— বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ক্ষতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আর সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের ৬৭ শতাংশই ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীরা।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, দেশের কর্মক্ষম ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। যার প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক ক্ষতি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের জন্য গর্ব করে। সড়ক দুর্ঘটনা এ গর্বের জায়গাতেই বেশি আঘাত হানছে। পুলিশের তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) বলছে, গত এক দশকে দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আর দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সাড়ে ১৮ শতাংশ শিশু। এদের বয়স ১৫ বছরের নিচে।
মোজাম্মেল হক বলেন, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি প্রাণ হারানোয় ২৪ লাখ ৬২ হাজার ১০৬ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। সেই হিসেবে প্রত্যেক নিহত ব্যক্তির পরিবার এ পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্র থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার হকদার। যদিও সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এ গঠিত সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের আর্থিক সহায়তা তহবিল থেকে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ও আহত ব্যক্তিকে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান থাকলেও আইন কার্যকরের ৩ বছরের মাথায় এ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কার্যক্রম আজও শুরু হয়নি।
প্রতিবছর সড়কে প্রায় ৮ হাজার মানুষের প্রাণহানির ও ৮০ হাজার মানুষের পঙ্গুত্ব বরণ করার তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে ১৭ বছরের কম বয়সী শিশু ১২ হাজারের বেশি।
জরুরিভিত্তিতে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের আর্থিক সহায়তা কার্যক্রম চালুর দাবি জানান। একই সঙ্গে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল সক্রিয় করার দাবি জানায় সংগঠনটি।
ফিটনেস ছাড়া গাড়ি কীভাবে সড়কে নামে?
একটি বাসের দুজন যাত্রী মারা যায় এবং আরেক বাসের ১৬ জন মারা যান। মুখোমুখি সংঘর্ষের সময়ে যে বাসের ১৬ জন মারা যান সে বাসের সিটগুলো খুলে সব সামনে এসে পড়ে। অপর বাসটির সিটগুলো ঠিক ছিল। তিনি বলেন, ফিটনেস ছাড়া গাড়ি কীভাবে সড়কে নামে?
আজ শুক্রবার রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ ইনিশিয়েটিভ, সেবক ও ড্রাইভার্স ট্রেনিং সেন্টারের উদ্যোগে আয়োজিত সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক সংলাপে এ কথা বলেন বক্তারা।
বক্তারা বলেন, করোনায় গড়ে প্রতিদিন পাঁচজন মারা যায়। করোনাভাইরাসকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে সরকার তা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় গত ১০ বছরে প্রতিদিন গড়ে ১৪ জন মানুষ মারা গেছেন। কিন্তু এটাকে সরকার জাতীয় সমস্যা বা মহামারি হিসেবে দেখছে না।
সংলাপে সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কিত কিছু তথ্য তুলে ধরেন গবেষক কাজী আবুল আল আতাহিয়া। তিনি বলেন, ২০২১ সালে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ২৮৪ জন মারা যান। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। তাদের মধ্যে ৮৪ শতাংশই পঙ্গুত্বের শিকার। এই গবেষক আরও বলেন, করোনা মহামারিতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ১০ বছরে গড়ে প্রতিদিন ১৪ জন মারা গেলেও সড়ক দুর্ঘটনাকে মহামারি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে না।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, উন্নত দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনা দৈব হলেও আমাদের দেশের দুর্ঘটনা আমাদের নিজেদেরই তৈরি। এর জন্য ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অদক্ষ চালক ও অনিরাপদ সড়ক সবচেয়ে বেশি দায়ী। চালক দক্ষ, প্রশিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বে এখন সড়ক দুর্ঘটনা রোধের প্রধান বিবেচনার বিষয় হলো নিরাপদ চালক। একজন চালককে দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের বেশি গাড়ি চালানো যাবে না।
তিনি বলেন, শুধু ড্রাইভারকে দোষারোপ করলেও হবে না। সিস্টেমের পরিবর্তন প্রয়োজন। রাস্তা, যানবাহন ও চালক প্রতিটিই সঠিক ও টেকসই হতে হবে।
এ সময় গাড়ির ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার সময় স্বচ্ছতার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর জন্য বিআরটিএকে পরামর্শ দেন অধ্যাপক ড. সামছুল হক। সড়কে গাড়ি চালানোর সময় ভুল করলে শুধু অর্থদণ্ড নয়, ওই বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ বা ডিফেন্স ড্রাইভিংকে শাস্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শও দেন তিনি। উন্নত দেশগুলোতে এই পদ্ধতি চালু থাকার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কম হয় বলেও উল্লেখ করেন সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক এই গবেষক। রাস্তায় এবং গাড়িতে এলইডি লাইট ব্যবহার বিজ্ঞানসম্মত কি না, সেটি খতিয়ে দেখার কথাও বলেন বুয়েটের এই শিক্ষক।
আলোচনায় ন্যাশনাল রোড সেফটি অ্যালায়েন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল ওয়াহেদ জানান, গাবতলী টার্মিনালে চালকদের ঘুমানোর জন্য একটি আবাসনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব সিটি করপোরেশনে জমা দেয় তার সংগঠন। দাতারা এই খরচ বহন করতে রাজি হলেও শেষ পর্যন্ত আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। তাই এসব অনাকাঙ্ক্ষিত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করার আহ্বান জানান তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৫
আপনার মতামত জানানঃ