দেশি-বিদেশি অর্থায়নে বন্ধ পাটকলগুলো আধুনিকায়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সচল করার আহ্বান জানিয়েছে সংসদীয় কমিটি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সরকারপ্রধানকে অনুরোধ করার সুপারিশ করেছেন তারা। ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, গতকাল বৃহস্পতিবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয়। প্রশ্ন উঠেছে, পাটকল বন্ধে যদি সংসদীয় কমিটির অভিমত না থাকে, তাহলে কীভাবে সেগুলো বন্ধ করা হলো। কারা পাটকল বন্ধে সরকারের ভেতরে কলকাঠি নাড়ছে!
সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. মুজিবুল হকের সভাপতিত্বে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, শাজাহান খান, শামসুন নাহার এবং মো. আনোয়ার হোসেন (হেলাল) বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে বন্ধ ঘোষিত পাটকল শ্রমিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান এবং মামলা প্রত্যাহার/নিষ্পত্তি করে অবসায়ন হওয়া শ্রমিক-কর্মচারীদের জরুরি ভিত্তিতে সব পাওনাদি পরিশোধের সুপারিশ করেছে কমিটি। বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনকে (বিজেএমসি) একটি কার্যকর ও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনরুজ্জীবিতকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণেরও সুপারিশ করেছে ওই সভা।
অথচ এ বছর ২ জুলাই ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। করোনা মহামারির মধ্যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর সরকার যখন বিপুল প্রণোদনার মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান ধরে রাখবার চেষ্টা করছে সরকারের সিদ্ধান্তে তখন প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী ও ২৫ হাজার অস্থায়ী শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত হতে হয়। পাটকল বন্ধের কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই পাটকলগুলো লোকসান করেছে।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য ভিন্নমত প্রকাশ করেন। তাদের মতে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে, গত পাঁচ দশকে রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলোতে নতুন কোনো বিনিয়োগ হয়নি। যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নেও নেয়া হয়নি যথাযথ পদক্ষেপ। বারবার লোকসান ঠেকাতে পাটকল বন্ধ করার নিদান দেয়া হলেও লোকসানের কারণসমূহ খতিয়ে দেখা হয়নি। বিশেষজ্ঞ মহল তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করে দেখিয়েছেন যে, সীমিত বরাদ্দে প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেই লোকসানি মিলগুলোকে লাভজনক করা সম্ভব। কিন্তু সরকার তাদের প্রস্তবে কর্ণপাত করেনি বলে অভিযোগ তাদের।
পাটশিল্প বন্ধ করার পেছনে কাদের স্বার্থ রয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবের ইঙ্গিত মেলে ২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রাইভেটাইজেশন কমিশন প্রকাশিত বেসরকারীকরণকৃত শিল্পপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সমীক্ষা, ২০১০ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে। ওই প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৯৩ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল দেশের প্রায় ৭৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে এর মধ্যে ৩১টিই প্রতিষ্ঠানই বন্ধ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি কারখানাই আর চালানো সম্ভব হয়নি। বরং এসব ক্ষেত্রে সস্তায় জমি ও যন্ত্রপাতি লুট করা হয়েছে, অথবা পরিত্যক্ত জমি দেখিয়ে বিপুল ব্যাংকঋণ নেওয়া হয়েছে।
বিপুল জমি ও পরিত্যক্ত সম্পত্তির আধার পাটকলগুলোও একটি মহল করায়ত্ত করতে চায়। তারাই পাটকল বন্ধের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে বলে শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে সেগুলো বেসরকারি মালিকানায় দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা সংকুচিত করে মালিকদের মুনাফা বৃদ্ধির রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপকে ‘ধনী পুনর্বাসন’ কার্যক্রম হিসেবেও সমালোচনা করেছেন শ্রমিক সংগঠকরা। ভারতীয় ব্যবসায়ী ও সে দেসের পাটশিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে বাংলাদেশের পাটশিল্প নিয়ে চক্রান্ত হচ্ছে বলেও একাধিক সভা-সমাবেশে অভিযোগ করেছেন পাটকল রক্ষা আন্দোলনের নেতাকর্মীরা।
শ্রমিকপক্ষের অভিযোগ, পাট মন্ত্রণালয়েই পাটশিল্পের শত্রুরা বসে আছেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে পাটকল পরিচালনায়, পাট পরিবহনে এবং পাট কেনার বিভিন্ন স্তরে অনিয়ম এবং দুর্নীতি বহাল রেখেছেন। প্রকল্প প্রধান থেকে শুরু করে জুট ম্যানেজার, জুট হেড, পাট চেজার, পাট সাপ্লাইয়ার-দের একটা বড় অংশই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ শ্রমিকদের। শ্রমিক নেতারা বলেন, দুর্নীতির কারণে পাটকলগুলোর ব্যবস্থাপনা খরচ বেড়ে যাওয়ায় লোকসানও বাড়ছে। অথচ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকেই এখন পর্যন্ত চাকরি হারাতে হয়নি।
২০১৯ সালে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ, স্কপ-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বেশি উৎপাদন-ক্ষমতা সম্পন্ন আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় তাঁত বসালেই পাটকলগুলোর সক্ষমতা বাড়বে। স্কপের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে পুরোনো যন্ত্রপাতির বদলে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের একটি সুনির্দিষ্ট লিখিত প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল। ওই প্রস্তাব অনুযায়ী, সব মিলিয়ে মাত্র ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করলেই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা অনেকগুণ বৃদ্ধি পেতো এবং প্রতি ইউনিটে উৎপাদন খরচ অনেক কমে আসত বলে দাবি গবেষকদের।
সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন, অর্থের সঙ্কট নয়, বরং সদিচ্ছার অভাবই পাটশিল্পের লোকসানের মূল কারণ। বছরের পর বছর সমস্যাগুলো জিঁইয়ে রাখা হয়েছে, সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার তহবিলে পাটশিল্প রক্ষা করা সম্ভব বলা হলেও সরকার তার বদলে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে পাটকলগুলো বন্ধ করে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের জন্য। পাটশিল্পের বিকাশ রুদ্ধ করতে চায় যারা, সরকারের নীতিতে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন বরাবরই বেশি দেখা গেছে। এ অবস্থায় এখন সংসদীয় কমিটির সুপারিশ সরকারের অবস্থান পরিবর্তনে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে না বলেই মনে করছেন পাটকল রক্ষা আন্দোলন সংশ্লিষ্টরা।
এসডাব্লিউ/এসএন/আরা/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ