তুরস্কে একটি গ্যাস হাব বানাতে চায় মস্কো। সেই হাব থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। প্রয়োজনে এর জন্য একটি নতুন পাইপলাইন তৈরি করা হবে বলে জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। নতুন এই লাইনকে অভিহিত করা হচ্ছে “টার্ক স্ট্রিম” নামে।
ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, সম্প্রতি কাজাখস্তানে সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোর একটি নিরাপত্তা সংক্রান্ত বৈঠক হয়। সেখানে তুরস্ক এবং রাশিয়া দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানই উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকের ফাঁকেই দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন এরদোয়ান ও পুতিন। সেখানেই গ্যাস হাব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়।
পুতিনের প্রস্তাব, তুরস্কে একটি গ্যাস হাব তৈরি করা হবে। সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হবে বলেও প্রস্তাব দিয়েছেন পুতিন। কৃষ্ণসাগরের তলদেশ দিয়ে রাশিয়া থেকে একটি গ্যাসের পাইপলাইন তুরস্ক হয়ে পূর্ব ইউরোপে যায়। সেটিকে তুরস্ক স্ট্রিম পাইপলাইন বলা হয়। এবার আরেকটি টার্কি স্ট্রিম পাইপলাইন তৈরি করতে চাইছেন পুতিন। যা কেবলমাত্র ওই হাবের জন্যই তৈরি হবে।
রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা নর্ড স্ট্রিমের গ্যাসগুলো বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে কৃষ্ণ সাগরীয় অঞ্চলে পাঠাতে পারি। এভাবে আমাদের জ্বালানি, প্রাকৃতিক গ্যাস তুরস্ক হয়ে ইউরোপে পাঠানোর প্রধান পথ তৈরি করতে পারি, তুরস্ককে ইউরোপের গ্যাসের সর্ববৃহৎ হাব করতে পারি।
পুতিন জানান, নর্ড স্ট্রিমের সঙ্গে এই পাইপলাইনকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। বস্তুত, নর্ড স্ট্রিম দিয়ে জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করে রাশিয়া। গত কিছুদিনে সেই সরবরাহ অনেকটাই কমেছে। একমাত্র তুরস্কের পাইপলাইন দিয়েই এখনো গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক।
বৃহস্পতিবারের বৈঠকে মূলত বাণিজ্য ইস্যুতে আলোচনা হয়। এরদোয়ান তুরস্কের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রসঙ্গ তোলেন। এ সময় পুতিনকে তুরস্কের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে জানান এরদোগান। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি তুরস্কের উত্তরাঞ্চলে তৈরি করে দেবে রাশিয়া।
তবে আলোচনায় গুরুত্ব পায় রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস অন্যান্য দেশে সরবরাহের ব্যবস্থা তৈরিতে তুরস্কের কাছে পুতিনের সহায়তা চাওয়ার বিষয়টি। ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের জন্য তুরস্ককে ব্যবহার করতে চায় রাশিয়া। গ্যাস সরবরাহ করতে তুরস্কে একটি সাপ্লাই হাব তৈরির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। এ নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা হবে। এতে জ্বালানি সরবরাহের পাশাপাশি দাম নির্ধারণ করাও সহজ হবে বলে জানান পুতিন।
পুতিন বলেন, ‘গ্যাস সাপ্লাই হাব আমরা একসঙ্গে তৈরি করতে পারি। এটি কেবল সরবরাহের জন্য নয়, দাম নির্ধারণের জন্যও একটি প্ল্যাটফর্ম হবে। কারণ, মূল্য নির্ধারণের সমস্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গ্যাসের দাম অনেক বেশি। এই হাব হলে আমরা কোনো রাজনৈতিক চাপ ছাড়াই দাম স্বাভাবিক করতে পারব।’
এদিকে, পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় নিরাপদে রাশিয়ার শস্য অনুন্নত দেশগুলোতে রফতানির বিষয়ে জোর দেন এরদোয়ান। ইউক্রেনের শস্য রফতানির জন্য কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার অবরোধের মুখে থাকা বন্দরগুলো খুলে দিতে গত জুলাইয়ে যে চুক্তি হয় ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে, এতে মধ্যস্থতা করে তুরস্ক।
আমরা নর্ড স্ট্রিমের গ্যাসগুলো বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে কৃষ্ণ সাগরীয় অঞ্চলে পাঠাতে পারি। এভাবে আমাদের জ্বালানি, প্রাকৃতিক গ্যাস তুরস্ক হয়ে ইউরোপে পাঠানোর প্রধান পথ তৈরি করতে পারি, তুরস্ককে ইউরোপের গ্যাসের সর্ববৃহৎ হাব করতে পারি।
এরদোয়ান বলেন, ‘আমরা ইস্তাম্বুল চুক্তির অধীন শস্য রফতানি জোরদার করতে এবং তুরস্কের মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে রুশ শস্য ও সার স্থানান্তর করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। উন্নত দেশগুলোর পরিবর্তে দরিদ্র দেশগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়া জরুরি। আমি মনে করি এটি করলে স্বল্পোন্নত দেশগুলো উপকৃত হবে।’
তবে বৈঠকে ইউক্রেন সংকট সমাধানের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ।
ন্যাটোর আপত্তি
ন্যাটোর প্রতিনিধি হয়েও তুরস্ক কেন রাশিয়ার সঙ্গে এ ধরনের আলোচনা চালাচ্ছে, কেন তুরস্ক রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা মানছে না, এ নিয়ে ন্যাটো এরদোয়ান সরকারের ওপর চাপ বাড়িয়েছে।
এরদোয়ান অবশ্য বলেছেন, তিনি এ বিষয়ে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে চান। বস্তুত, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতা করছে তুরস্ক। শুধু তা-ই নয়, খাদ্যশস্য সরবরাহ নিয়েও দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছিল তুরস্ক। জাতিসংঘও ছিল সেখানে।
সম্প্রতি এরদোয়ান জানিয়েছেন, খাদ্যশস্য সরবরাহ শুরু হলেও তা কেবলমাত্র ধনী দেশগুলোতে যাচ্ছে। দরিদ্র দেশগুলো এখনও বঞ্চিত। এজন্য কার্যত পশ্চিমা দেশগুলোকে দায়ী করেছেন তিনি।
রাশিয়া তাদের নর্ড স্ট্রিম গ্যাস সরবরাহ পাইপলাইন থেকে সরে এসে নতুন পথে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের উপায় খুঁজছে।
রাশিয়া ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরুর পর থেকে নর্ড স্ট্রিম ১ এবং ২ পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ অনেকবারই ব্যাহত হয়েছে। উপরন্তু গত মাসে বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া এই পাইপলাইনে বিস্ফোরণ ঘটে সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং একাধিক ফুটো শনাক্ত হয়েছে।
এই ঘটনার তদন্ত এখনও চলছে এবং রাশিয়া পাইপলাইনে বিস্ফোরণের জন্য পশ্চিমাদেরকে দায়ী করেছে। যদিও এর কোনও প্রমাণ তারা দিতে পারেনি। ওদিকে, ইউরোপ বিস্ফোরণের ঘটনাকে নাশকতা বলে মনে করছে।
রাশিয়া এর আগেও বিভিন্ন সময় নর্ড স্ট্রিমের ‘ত্রুটি মেরামতের কথা বলে এ পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। ইউরোপের অভিযোগ, ইচ্ছাকৃতভাবে রাশিয়া একাজ করেছে। তবে মস্কো বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
পরিণতি কোন দিকে যাচ্ছে?
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করার জন্য গত শুক্রবার ফোনে আলোচনা করেছিলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। দুই দেশের সম্পর্ক গভীর হওয়া নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ন্যাটোর অন্যান্য বেশ কয়েকটি সহযোগী রাষ্ট্রের মধ্যে।
এরদোয়ানের কার্যালয় থেকে এক প্রেস বিবৃতিতে এই ফোনালাপের কথা জানানো হয়।
এতে বলা হয়েছে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনে সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানে তার কাজ করার ইচ্ছা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
পুতিনের সঙ্গে এরদোয়ানের গত কয়েক মাসে তিনটি মুখোমুখি বৈঠকের পরে এই ফোনালাপ হয়।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে অস্বীকার করাসহ তুর্কি নেতার সম্পর্ক আরও গভীর করার প্রচেষ্টা, তার পশ্চিমা অংশীদার এবং ন্যাটোর প্রতি তুরস্কের প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান প্রশ্ন উঠছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ভয়েস অব আমেরিকার।
তুর্কি-রাশিয়ার আর্থিক সম্পর্ক গভীর করা নিয়ে পশ্চিমাদের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় মাত্রার নিষেধাজ্ঞার হুমকির মুখে তুরস্কের ব্যাংকগুলো গত মাসে রাশিয়ার মীর পেমেন্ট সিস্টেম থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। মস্কো রাশিয়ার আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে যাবার জন্য এই সিস্টেমটি ব্যবহার করছিল।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আঙ্কারা তার পশ্চিমা মিত্রদের উপর প্রভাব বজায় রেখেছে। সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদানের অনুমতির জন্য তুরস্কের অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। এরদোয়ান ন্যাটোতে সুইডেনের অন্তর্ভূক্তির প্রস্তাব বন্ধ করার জন্য সম্প্রতি পুনরায় হুমকি দিয়েছেন।
ভৌগোলিকভাবে তুরস্ক রাশিয়া, ইউক্রেন এবং ইরান ও সিরিয়ার মতো অন্যান্য অশান্ত অঞ্চলের কাছাকাছি থাকায় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এরদোয়ান তার দেশের কৌশলগত গুরুত্ব এবং পশ্চিমা মিত্রদের অব্যাহত সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ