ইরানে নিকা শাকারামি নামের ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীর বিক্ষোভ করার ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। নিকা শাকারামির মা বিবিসি পার্সিয়ানকে বলেন, ভিডিওগুলো তার মেয়ে মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে ধারণ করা।
সূত্র মতে, নিকা তার হিজাব পোড়ানোর একটি ভিডিও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছিল। নিকা বন্ধুকে বলেছিল, এর পর থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাকে অনুসরণ করছেন। নিকার সঙ্গে ১০ দিন আর পরিবারের যোগাযোগ হয়নি। পরে একটি বন্দিশিবিরের মর্গে তাঁরা ওই কিশোরীর লাশ খুঁজে পান।
কী বলছে পরিবার?
নিকার পরিবার বলছে, নিখোঁজ হওয়ার ১০ দিন পর একটি মর্গে নিকার লাশ শনাক্ত করেছে তারা। নিকাকে শনাক্ত করতে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার মুখ দেখতে দেওয়া হয়েছিল।
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, নিকা শাকারামি ২০ সেপ্টেম্বর তেহরানে একটি বড় ডাস্টবিনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং তার হিজাব পুড়িয়ে ফেলছে। ঘটনাস্থলে থাকা অন্য বিক্ষোভকারী ব্যক্তিরা ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতা করে স্লোগান দিচ্ছিলেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনিকে উদ্দেশ্য করে তারা বলতে থাকেন—‘স্বৈরশাসক নিপাত যাক।’
আরেকটি ভিডিওতেও একই দৃশ্য দেখা গেছে। তবে ওই ভিডিওটি ভিন্ন দিক থেকে ধারণ করা। ওই বিক্ষোভের কয়েক ঘণ্টা পর নিকা নিখোঁজ হয়। নিখোঁজ হওয়ার আগে সে এক বন্ধুকে বলেছিল পুলিশ তাকে ধাওয়া করছে।
নিকার মা নাসরিন অভিযোগ করেছেন, নিরাপত্তা বাহিনী তার মেয়েকে হত্যা করেছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নির্মাণাধীন একটি ভবনের ওপর থেকে ফেলে দেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়েছে। নির্মাণ শ্রমিকেরা তাকে ফেলে দিয়ে থাকতে পারেন বলে মনে করছেন তারা।
গত সপ্তাহে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ঝাপসা ফুটেজে দেখা গেছে এক নারী একটি সরু গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এবং একটি ভবনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। ওই ফুটেজে দেখা যাওয়া নারীকে নিকা বলে উল্লেখ করা হয়।
গতকাল সোমবার বিবিসি পার্সিয়ানকে নিকার মা নাসরিন বলেন, ওই ভিডিওতে যাকে দেখা যাচ্ছে, সে তার মেয়ে নয়। ওই পরিবারের ঘনিষ্ঠ আরেকটি সূত্র বলেছে, ভিডিওতে যাকে দেখা গেছে তার হাঁটাচলার ধরনের সঙ্গে নিকার মিল নেই।
মা নাসরিন আরও অভিযোগ করেছেন, তার বোন আতাশ এবং ভাই মোহসেনকে আটকে রেখে তাদের কাছ থেকে জোর করে নিকার মৃত্যু সম্পর্কে মিথ্যা জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।
নাসরিন বলেন, ‘তারা আমার ভাইয়ের চার বছর বয়সী সন্তানকে আটকের হুমকি দিয়েছিল।’
ইসলামী বিপ্লব নাকি স্বৈরতন্ত্র?
গত বুধবার রাতে টিভি শোতে দেখা গেছে, নিকার মামা মোহসেন চলমান বিক্ষোভের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। ক্যামেরার পেছন থেকে কেউ একজন তাকে এসব কথা বলতে চাপ দিচ্ছিলেন। আর নিকার খালা আতাশ বলছিলেন, তার বোনের মেয়ে একটি ভবন থেকে পড়ে মারা গেছে। এসব জবানবন্দি দেওয়ার পর আতাশ ও মোহসেনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
আতাশের ভাষ্য, রেভল্যুশনারি গার্ডের সদস্যরা তাকে বলেছেন যে নিকা পাঁচ দিন ধরে তাদের হেফাজতে ছিল। পরে তাকে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ইরানে পুলিশি হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চলমান বিক্ষোভে মারা গেছে নিকার মতো আরও কয়েকজন কিশোরী।
এদিকে, গত ২৩ সেপ্টেম্বর কারাজে বিক্ষোভ করার সময় ১৬ বছর বয়সী কিশোরী সারিনা ইসমাইলজাদেহ নিহত হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সারিনার মাথায় লাঠি দিয়ে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছিলেন।
এর আগে ২১ সেপ্টেম্বর কারাজ শহরে বিক্ষোভ করার সময় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মারা যান ২২ বছর বয়সী নারী হাদিস নাজাফি।
গতকাল ইরানিয়ান সোসাইটি ফর প্রটেকটিং দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলমান বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ২৮ জন শিশু-কিশোর মারা গেছে। আরও অনেক শিশুকে আটক রাখা হয়েছে।
হিজাব না পরে কঠোর পর্দাবিধি ভঙ্গ করার অভিযোগে ১৩ সেপ্টেম্বর ইরানের নীতি পুলিশ ২২ বছর বয়সী মাসাকে আটক করেছিল। পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর তিনি কোমায় চলে যান। ১৬ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাসার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পরে সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
ইসলামী বিপ্লবে নারীরা
ঠিক ৪০ বছর আগে ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লব দেশটিতে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছিল সেদেশের মেয়েদের জীবন ও পোশাকের ক্ষেত্রে। ইরানের শাহ ১৯৩০ এর দশকে মেয়েদের নিকাব নিষিদ্ধ করেছিলেন, পুলিশকে আদেশ দেয়া হয়েছিল কোন মেয়ের মাথায় হিজাব থাকলে তা জোর করে খুলে দিতে। কিন্তু ১৯৮০র দশকের শুরুতে নতুন ইসলামী কর্তৃপক্ষ মেয়েরা কি পোশাক পরবে তার এক নতুন ও বাধ্যতামূলক নিয়ম বলবৎ করেন। এতে বলা হয়, সব নারীকে হিজাব পরতে হবে।
বিপ্লবের আগে ইরানী মেয়েদের অনেকেই পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরতেন, যার মধ্যে টাইট-ফিটিং জিনস, মিনিস্কার্ট, ছোট হাতাওয়ালা জামা, সবই ছিল।
এরপর আসে ইসলামী বিপ্লব। যারা হিজাব ঠিকমত পরে না বা ইসলামি রীতি মেনে সাজপোশাক করে না, ইরানি কর্তৃপক্ষ তাদের “হিজাব ঠিকমত না পরার” বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পরপরই। ওই বিপ্লবের একটা বড় লক্ষ্য ছিল নারীদের খোলামেলা সাজপোশাক বন্ধ করা।
যদিও সেসময় ইরানের অনেক নারীই ইসলামি রীতি অনুযায়ী পোশাক পরতেন, কিন্তু পশ্চিমাপন্থী শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলাভিকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনের আগে তেহরানের রাস্তায় নারীদের খাটো স্কার্ট পরে এবং মাথা না ঢেকে চলাফেরা করতে দেখা যেত।
তার স্ত্রী ফারাহ, যিনি প্রায়শই পশ্চিমা পোশাক পরতেন, তাকে ইরানে আধুনিক নারীর একজন আদর্শ হিসাবে মনে করা হতো।
ইরান ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবার কয়েক মাসের মধ্যেই শাহ-এর শাসনামলে নারীদের অধিকার সুরক্ষিত করে যেসব আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল সেগুলো তুলে নেবাার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
৭৮ বছর বয়স্ক একজন মানবাধিকার আইনজীবী এবং আন্দোলনকারী মেহেরাঙ্গিজ কার বলেন, “সেটা অবশ্যই রাতারাতি হয়নি, সেটা পর্যায়ক্রমে ঘটেছে।” দেশটির প্রথম হিজাব-বিরোধী বিক্ষোভ আয়োজনে তিনি সহযোগিতা করেছিলেন।
“বিপ্লবের ঠিক পরে পরেই, রাস্তায় রাস্তায় পুরুষ ও নারীরা উপহারের মোড়কে মুড়ে নারীদের হিজাব বিলি করতেন।”
বিপ্লবের নেতা, আয়াতোল্লাহ রুহুল্লা খোমেইনি ১৯৭৯ সালের ৭ই মার্চ ডিক্রি বা নির্দেশনামা জারি করেন যে সব নারীকে তাদের কর্মক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে হিজাব পরতে হবে এবং নারীরা মাথা না ঢাকলে তার বিচারে সেইসব নারী ”নগ্ন” বলে গণ্য হবেন।
“তার সেই ভাষণকে বহু বিপ্লবী নারীদের হিজাব পরতে বাধ্য করার নির্দেশ হিসাবে গ্রহণ করেছিল। অনেকেই মনে করেছিল এই নির্দেশ রাতারাতি কার্যকর করা হচ্ছে। তাই নারীরা বিরোধিতা শুরু করেছিল।”
এই নির্দেশে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল তাৎক্ষণিক। আয়াতোল্লাহ খোমেইনির ভাষণের পরদিনই বিক্ষোভ জানাতে তেহরানের রাস্তায় জড়ো হন এক লাখের ওপর মানুষ, যাদের বেশিরভাগই ছিল নারী। সেদিন ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
আয়াতোল্লাহ খোমেইনি ডিক্রি জারি করার পরও, নারীর “সঠিক” পোশাক কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কর্তৃপক্ষের বেশ কিছু সময় লেগেছিল।
“কোন স্পষ্ট নির্দেশ ছিল না এ ব্যাপারে। ফলে তারা বিভিন্ন অফিসের দেওয়ালে ঝোলানো মডেলদের ছবি দিয়ে পোস্টার আর ব্যানার তৈরি করে আনল। তারা বলল নারীদের হিজাব পরার ব্যাপারে নির্দেশগুলো মানতে হবে, না হলে তাদের ঢুকতে দেয়া হবে না।”
এরপর ১৯৮১ সালে নারী ও কিশোরীদের ইসলামি রীতি অনুযায়ী আব্রু রক্ষা করার উপযোগী পোশাক পরা আইনত বাধ্যতামূলক করা হল। এর অর্থ হল নারীদের চাদর পরতে হবে অর্থাৎ তাদের পা অবধি পুরো শরীর ঢাকা ঢিলা পোশাক পরতে হবে এবং তার সাথে পারলে নিচে ছোট একটা স্কার্ফ পরতে হবে। অথবা পুরোদস্তুর হিজাব এবং তার সাথে লম্বা হাতা ওভারকোট দিয়ে শরীর ঢাকতে হবে।
মেহেরাঙ্গিজ কার বলেন, তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাধ্যতামূলকভাবে হিজাব পরার বিরুদ্ধে লড়াই চলতেই থাকে। মাথা ঢাকার স্কার্ফ পরার ব্যাপারে অথবা চুল সঠিকভাবে পুরোপুরি না ঢাকার ব্যাপারে আমরা সৃজনশীল হয়ে উঠি। প্রত্যেকবার তারা যখন আমাদের বাধা দিত, আমরা সংগ্রাম করতাম।
পার্লামেন্ট ১৯৮৩ সালে সিদ্ধান্ত নিল যেসব নারী প্রকাশ্যে মাথা ঢাকবে না, তাদের শাস্তি হিসাবে ৭৪ বার বেত্রাঘাত করা হবে। আরও সম্প্রতি এই সাজার সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে ৬০ দিন পর্যন্ত কারাবাস।
তবে এরপরেও তখন থেকেই এই আইন পুরোপুরি কার্যকর করতে কর্তৃপক্ষকে বেগ পেতে হয়েছে। সব বয়সের নারীকেই প্রায়ই দেখা যাচ্ছে রাস্তাঘাটে বা প্রকাশ্যে সীমানা লংঘন করে আঁটোসাঁটো জামা বা উরু পর্যন্ত ঝুলের খাটো কোট পরতে। সেইসঙ্গে উজ্জ্বল রং-এর হেডস্কার্ফ এমনভাবে পেছনের দিকে ঠেলে পরতে, যাতে তাদের চুলের অনেকটা অংশ বেরিয়ে থাকে।
এই আইন কতটা কঠোরভাবে বলবৎ করা হবে এবং আইন লংঘনের জন্য সাজা কতটা কঠোর হবে, তা গত কয়েক বছরে নির্ভর করেছে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের ওপর। প্রেসিডেন্ট পদের জন্য ২০০৪ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তৎকালীন তেহরানের অতি রক্ষণশীল মেয়র মাহমুদ আহমেদিনিজাদ কিন্তু এ বিষয়ে তার প্রচারণায় অনেক প্রগতিশীল অবস্থান নেন।
সেসময় টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “প্রত্যেক মানুষের রুচি আলাদা, এবং সকলের সেবা করার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।”
তবে পরের বছর নির্বাচনে তিনি জেতার মাত্র কিছুদিন পরই আনুষ্ঠানিকভাবে গঠন করা হয় গাশ্ত-ই এরশাদ বাহিনী। এর আগে পর্যন্ত নারীদের ইসলামি পোশাক পরার ওপর অনানুষ্ঠানিকভাবে নজরদারি করত দেশটির অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এবং আধাসামরিক ইউনিটগুলো।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৫৫
আপনার মতামত জানানঃ