ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানব পাচার করে নানা চক্র। মিথ্যা প্রলোভনে নিরীহ ও বেকার তরুণদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর এসব কাজে সরকারি কর্মকর্তারাও জড়িত আছেন বলে জানা গেছে।
সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈদেশিক কর্মসংস্থানে অনিয়ম ঠেকানোর দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোই (বিএমইটি) ঠকাচ্ছে বিদেশগামী কর্মীদের। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সিন্ডিকেট জালিয়াতি করে সংযুক্ত আরব আমিরাতগামী কর্মীদের ভুয়া বহির্গমন ছাড়পত্র (স্মার্ট কার্ড) দিয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ অনুমতি ছাড়াই, অর্থাৎ চাকরি না দিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালরা ভুয়া স্মার্ট কার্ডে কর্মীদের বিদেশ পাঠিয়েছে। বিএমইটির ৯ কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং ছয় রিক্রুটিং এজেন্সি জালিয়াতিতে জড়িত বলে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে তদন্ত হয়েছে সীমিত পরিসরে- আমিরাতে লোক পাঠানো মাত্র আটটি এজেন্সির বিরুদ্ধে। অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও স্মার্ট কার্ডে একই ধরনের জালিয়াতি ঘটেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত ২৮ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন জমা হলেও এখনও ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়। তবে ইতালি সফরে থাকা প্রবাসীকল্যাণ সচিব ড. আহমেদ মনিরুছ সালেহীন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, কমিটি প্রতিবেদন সংশোধন করে মাসখানেক আগে ফের জমা দিয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হবে। কেউ ছাড় পাবে না।
মন্ত্রণালয়ের তদন্তে জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তারাই কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। শুধু রিক্রুটিং এজেন্সি নয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে নেওয়া স্মার্ট কার্ড বিক্রি করা হয়েছে আদম ব্যাপারী, এমনকি দালালের কাছেও। এজন্য কর্মীপ্রতি ৩ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্মার্ট কার্ড জালিয়াতি সিন্ডিকেটে জড়িত বিএমইটির সিস্টেম অ্যানালিস্ট সাইদুল ইসলাম। তিনি ২০১৯ সালে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন ডাটাবেজের তথ্য মুছে ফেলার অপরাধে। বাকিরা হলেন- জনশক্তি জরিপ কর্মকর্তা ইমারত হোসেন মোল্লা, বহির্গমন শাখার প্রধান সহকারী শামীমা ফেরদৌসী, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সাইফুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক শেলীনা আক্তার, লিটন কান্তি চৌধুরী, উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ, পরিচালক (যুগ্ম সচিব) হাসান মাহমুদ ও পরিচালক (উপসচিব) মিজানুর রহমান ভূঁইয়া। প্রতিবেদনে নাম এসেছে বিএমইটির মহাপরিচালক শহীদুল আলমেরও।
সরকারি কর্মকর্তারাই কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। শুধু রিক্রুটিং এজেন্সি নয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে নেওয়া স্মার্ট কার্ড বিক্রি করা হয়েছে আদম ব্যাপারী, এমনকি দালালের কাছেও। এজন্য কর্মীপ্রতি ৩ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইডিয়া ইন্টারন্যাশনালের ৩২৫ জন কর্মীর নিয়োগ অনুমতির বিপরীতে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর ৩১৫ জনকে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়। ১০টি অবশিষ্ট থাকলেও পাঁচ দফায় ৪৯৩টি স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ৬ ফেব্রুয়ারি নোটশিটের ৭৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়, কোনো স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়নি। কিন্তু ৮০ অনুচ্ছেদে সাইদুল ইসলাম মতামত দেন, গত বছরের ৮ ডিসেম্বরের ২৫০ কর্মীর নিয়োগ অনুমতির বিপরীতে ১৫০টি স্মার্ট কার্ড অবশিষ্ট রয়েছে।
তিনি এই অসত্য মতামত দেওয়ার দু’দিন পর মহাপরিচালক শহীদুল আলম দুবাইগামী ১৫০ কর্মীকে বহির্গমন ছাড়পত্র দিতে অবৈধ অনুমতি দেন। পরের দিন স্মার্ট কার্ডগুলো ইস্যু করা হয়। এ ক্ষেত্রে বহুমুখী জালিয়াতি, অসততা ও অনিয়ম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশি কর্মীদের চাকরি নিয়ে বিদেশ যেতে কয়েকটি ধাপ পেরোতে হয়। কর্মী যে দেশে যাবেন, সে দেশের নিয়োগকারী চাহিদাপত্র দেয় বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সি বা সংশ্নিষ্ট দেশের এজেন্সিকে। চাকরি আছে কিনা, কর্মী বেতন পাবেন কিনা, তা যাচাই করে চাহিদাপত্র সত্যায়িত করে বাংলাদেশি দূতাবাস। চাহিদাপত্র দেশে আসার পর নিয়োগ অনুমতি দেয় প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। আঙুলের ছাপ ও বিভিন্ন ফি নিয়ে নিয়োগ অনুমতির বিপরীতে কর্মীকে স্মার্ট কার্ড দেয় বিএমএইটি। এতে তার সব বায়োমেট্রিক তথ্য থাকে।
বিমানবন্দরে এ কার্ড দেখিয়ে বাংলাদেশ ছাড়তে হয়। মন্ত্রণালয় যতজন কর্মীর নিয়োগের অনুমতি দেয়, এর বেশি সংখ্যক কর্মীকে স্মার্ট কার্ড দেওয়ার সুযোগ নেই।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির তদন্তে প্রমাণ হয়েছে, আরব আমিরাতে ২ হাজার ৯৬০ জন কর্মীর নিয়োগ অনুমতির বিপরীতে ৬ হাজার ৯৩৮টি স্মার্ট কার্ড দিয়েছে বিএমইটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩ হাজার ৯৭৮টি স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে ন্যক্কারজনক ও অকল্পনীয় জাল-জালিয়াতি করে। অভিযোগ আছে, প্রতিটি ভুয়া কার্ডের জন্য ২ থেকে ৩ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছে অভিযুক্তরা।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, অন্যান্য নিয়োগ অনুমতির ক্ষেত্রে আরও কত স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে এর হিসাব নেই। তবে সংখ্যাটি অনেক বড়। ২০২১ সালে ২৯ হাজার ২০২ জন এবং ২০২২ সালে আগস্ট পর্যন্ত ৭০ হাজার ২০৩ বাংলাদেশি কর্মী আমিরাতে গেছেন। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও অবৈধভাবে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে কিনা, তার তদন্ত হয়নি।
বিদেশে মানব পাচার ও অবৈধ প্রবাসী বাংলাদেশের শ্রম বাজারের জন্য সব থেকে বড় সমস্যা। যা দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। বাংলাদেশের মানব পাচার ও অবৈধ প্রবাসীদের বিষয়ে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা উদ্বেগও প্রকাশ করেছে।
হিউম্যান ট্রাফিকিং ও অবৈধ প্রবাসীদের সমস্যা নিয়ে এসব সংস্থা নিয়মিত তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে সর্তক করে আসছে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের মানব পাচার বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে টায়ার-২ ওয়াচ লিস্টেও রাখা হয়েছে। এত কিছুর পরেও টনক নড়ছে না বাংলাদেশ সরকারের।
সময়ের প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে সাগর প্রবাহে বেড়েই চলছে বাংলাদেশী মানবদের পাচার। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সাগর পথে মানব পাচারের সব থেকে বড় উৎস এখন বাংলাদেশ।
বিভিন্ন মানবধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সৌদি আরব, লিবিয়া, লেবানন ও ওমানসহ বিভিন্ন গলফ দেশগুলোতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পরে তাদের নির্দিষ্ট কোম্পানিতে হস্তান্তর না করে কিংবা কাজ না দিয়ে দিনের পর দিন নির্যাতন চালানো হয়। এক সময় তাদের উন্নত দেশে নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। পরে মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আফ্রিকার কোনো দেশে জাহাজে কিংবা তেলের ট্যাংকারে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি অভিবাসী রাস্তায় মারা যায়, আর যারা বেঁচে যান তাদের পোহাতে হয় সীমাহীন ভোগান্তি।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, “চাকরি, বিয়ে ও অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে পুরুষ ও নারীদের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে। আর যারা পাচার না হন তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সৌদি ফেরত নারীদের দেখলেই এর বাস্তব চিত্র বুঝা যায়।
তারা বলেন, দেশের ভিতরে প্রভাবশালী এজেন্সিগুলোর প্রভাবে এতই যে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আর বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশী অ্যাম্বাসিগুলোর কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তারাও এই মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকায় এই সমস্যা সমাধান এখনো হচ্ছে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩৭
আপনার মতামত জানানঃ