চলতি বছরে মানব পাচার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদনের র্যাংকিংয়ে তৃতীয়বারের মতো একই জায়গায় অবস্থান করছে বাংলাদেশ। তবু মানব পাচার বন্ধে আইনের যথাযথ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না।
১৮ বছরে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে ৭ হাজার ৫১৭টি। নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৪৭টি মামলা। মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে সবচেয়ে বেশি ৪০ শতাংশ মামলা ঢাকা বিভাগে। সবচেয়ে কম মাত্র ১ শতাংশ মামলা রংপুর বিভাগে। যার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র মাত্র ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ মামলার।
ভয়াবহ পরিসংখ্যান
পুলিশ সদর দপ্তরের হালনাগাদ তথ্য বলছে, গত ১৮ বছরে দেশে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে ৭ হাজার ৫১৭টি। নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৪৭টি, যা মোট মামলার মাত্র ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানব পাচারসংক্রান্ত ৫৩৮টি মামলা তদন্ত করেছে। ওই বছরে মানব পাচার আইনের অধীনে করা মাত্র একটি মামলার রায় হয়েছে। আর চলতি বছরে হয়েছে ১১টি মামলার রায়।
দেড় যুগে শাস্তি হয়েছে ৪৩৪ জন পাচারকারীর। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ৩১ হাজার ১০১ জন। তাদের মধ্যে গত ১৮ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৪ হাজার ৫৩৮ জন।
এ সময় মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা ১৩ হাজার ৪২৪ জনকে বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন। আর সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা উদ্ধার করেছে ১০ হাজার ৫৭৯ জনকে। মানব পাচারের মামলায় আটজনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে ২৯৯ জনের। অন্যান্য শাস্তি হয়েছে ১২৭ জনের।
মামলার তথ্য পর্যালোচনা করে পুলিশ সূত্র জানায়, মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা বিভাগে। মোট মামলার ৪০ শতাংশ হয়েছে এ বিভাগে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২২ শতাংশ মামলা হয়েছে খুলনা বিভাগে। সবচেয়ে কম মাত্র ১ শতাংশ মামলা রংপুর বিভাগে।
ভুক্তভোগীদের কথা
৯ বছর আগে জমি বিক্রি ও বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে ইরাকে যান টাঙ্গাইলের মাসুদ রানা। সেখানে কোনো কাজ পাননি, উল্টো নির্যাতনের শিকার হয়ে ৯ মাস পরে দেশে ফিরে আসেন। মামলা করেন মেঘনা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক নাসির উদ্দিনসহ জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। ওই এজেন্সির মাধ্যমেই ইরাকে গিয়েছিলেন তিনি।
দেড় মাস তদন্ত করে ঢাকার বিমানবন্দর থানার মামলায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
মাসুদ রানা বলেন, ইরাকে যাওয়ার পর কাজ না দিয়ে মরুভূমির একটি ক্যাম্পে তাকে সহ ২৭ জনকে আটকে রাখা হয়। বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে কোনোমতে খেয়ে বেঁচেছিলেন। মাসুদ বলেন, ‘টাকা খরচ করে মামলার কাজে কয়েকবার ঢাকার আদালতে গিয়েছি। কিন্তু ১০ বছরেও বিচার পাইনি। আসামিরাও জামিনে বেরিয়ে গেছেন।’
মাসুদ রানার মতোই আর্থিক সমস্যা থেকে পরিবারকে মুক্তি দিতে এক যুগ আগে মিসরে গিয়েছিলেন নওগাঁর মো. বাবু। সেখানে গিয়ে কাজ পাননি। নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসেন। মামলাও করেছিলেন পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু বাবুর করা মামলার বিচার শেষ হয়নি ৯ বছরেও।
পাচারের পর মুক্তিপণ দাবি
বাংলাদেশ থেকে কোন কোন দেশে মানব পাচার বেশি হয়, তা–ও তুলে ধরা হয়েছে ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমের (ইউএনওডিসি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। এতে বলা হয়, ভারত, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই, থাইল্যান্ড, ইতালি, গ্রিস, পর্তুগাল, সাইপ্রাস, স্পেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, ওমান, কাতার, ইরাক, বাহরাইনে ও লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের বেশি পাচার করা হয়।
ইউরোপে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে লিবিয়া, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে নিয়ে জিম্মি করা হচ্ছে মানুষকে। পরে নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে মুক্তিপণ আদায় করছেন মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলাও হয়। মুক্তিপণের টাকা লেনদেনের সূত্র ধরে দেশে একাধিক মানব পাচারকারীকে শনাক্ত করেছে সিআইডি। তারা বলছে, অপহরণে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
চার বছর আগে কিশোরগঞ্জের মাজহারুল ইসলাম গিয়েছিলেন ইরাকে। ইরাকের কিরকুক এলাকা থেকে তাঁকে অপহরণ করা হয়। অজ্ঞাত স্থানে আটকে ব্যাপক মারধর করে পরিবারের কাছে ২০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। ছেলেকে বাঁচাতে টাকা দিতে রাজি হোন মাজহারুলের বাবা।
পরে মানব পাচার চক্রের সদস্যদের দেওয়া একটি নম্বরে বিভিন্ন সময় পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এ টাকা লেনদেনের সূত্র ধরে দেশে থাকা ওই চক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এ ঘটনায় রাজধানীর ভাটারা থানায় মামলা হয়।
মামলার বাদী সিআইডির এসআই খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, এ চক্রের প্রধান ফরিদপুরের সুলতান আলম। তিনি ইরাকে বসে এ চক্র পরিচালনা করেন। সেখানে তাঁর সহযোগী রয়েছেন বাছের ও রুহুল আমীন। সাইফুল্লাহ বলেন, দেশে পাচারকারী চক্রের তিনজন সহযোগী রয়েছেন, যাঁরা মুক্তিপণের টাকা আদায় করেন। দেশ থেকে সিআইডি এ চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।
‘পদত্যাগ করতে বাধ্য হতেন’
মানব পাচারের মামলার নিষ্পত্তি কম হওয়া প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, সঠিকভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করে মামলার তদন্ত শেষ করার পর অভিযোগপত্র তৈরি করার দক্ষতা ও যোগ্যতা এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নেই বললেই চলে।
কোনো গণতান্ত্রিক দেশে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দোষী প্রমাণে ব্যর্থ হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মামলার পাবলিক প্রসিকিউটরসহ দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পদত্যাগ করতে বাধ্য হতেন।
এসডব্লিউএসএস/১৫৩৬
আপনার মতামত জানানঃ