মানব পাচারের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের সব এলাকার বাসিন্দারাই। তবে যেসব এলাকার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বেশি, সেখানে মানব পাচারের ঘটনাও বেশি। খুলনা বিভাগের পশ্চিমাঞ্চলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে দীর্ঘ স্থলসীমান্ত আছে। সেখান থেকে কলকাতাও খুব দূরে নয়।
২০২০ সালে মানব পাচার সবচেয়ে বেশি হয়েছে খুলনা বিভাগ থেকে। বাংলাদেশে মানব পাচার বিষয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রসঙ্গত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছে অনেক অঞ্চলের মানুষ। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে পাচারকারী চক্র।
মানব পাচার সংক্রান্ত বৈশ্বিক প্রতিবেদন-২০২২ এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আলোচকদের বক্তব্য থেকে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর বনানীতে হোটেল শেরাটনের ১২ তলার বলরুমে প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন দুই প্রতিনিধি জানান, মানব পাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এটিকে বৈশ্বিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সমন্বয় করে সরকার মানব পাচার রোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে।
দ্য গ্লোবাল অ্যাকশন এগেইনস্ট ট্রাফিকিং ইন পার্সন এন্ড দ্য স্মাগলিং মাইগ্রেন্টস বাংলাদেশ (গ্লোবাল.অ্যাক্ট বাংলাদেশ) প্রকল্পের অধীনে মানব পাচার সংক্রান্ত বৈশ্বিক প্রতিবেদন-২০২২ তৈরি করা হয়।
এটি বাস্তবায়ন করেছে ইউএনওডিসি ও আইওএম। প্রতিবেদনটি গতকাল বাংলাদেশে প্রকাশ করা হয়। এই প্রতিবেদনের পদ্ধতি, মূল ফলাফল ও নীতিগত সুপারিশ তুলে ধরেন গ্লোবাল.এ্যাক্টের গ্লোবাল কোঅর্ডিনেটর এইমি কম্রি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মিজানুর রহমান ও ইউএনওডিসির জাতীয় প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর মাহদি হাসান।
প্রতিবেদনটিতে ১৪১টি দেশের মানব পাচারবিষয়ক তথ্য তুলে ধরা হয়। গত ২০১৭-২১ সালের মধ্যে শনাক্ত করা পাচার মামলার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাপী, আঞ্চলিক ও জাতীয় স্তরে মানব পাচারের নিদর্শন এবং প্রবাহের একটি চিত্র তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনটিতে। প্রতিবেদনে মানব পাচার বিষয়ক ৮০০ মামলার সারাংশ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা মহামারির কারণে মানব পাচারের ঝুঁকি বেড়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধার করা ও অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষমতা কমেছে আরো। তবে এ সময় সেক্সুয়াল ট্রাফিকিং কম ঘটেছে। অনেক জায়গাই বন্ধ থাকা এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে সাব-সাহারান আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় দায়মুক্তির উচ্চমাত্রা দেখা গেছে। এই অঞ্চলের দেশগুলোতে পাচারকারীদের দোষী সাব্যস্ত করার সংখ্যা বাকি বিশ্বের তুলনায় কম দেখা গেছে।
কেন ভারতকে কেন্দ্র করে বাড়ছে মানবপাচার?
বাংলাদেশে ২০২০ সালে যেসব মানব পাচারের ঘটনা শনাক্ত করা গেছে তার বেশিরভাগই ঘটেছে ঢাকা, খুলনা ও সিলেট বিভাগীয় অঞ্চলে। জাতিসংঘের মানবপাচার বিষয়ক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম এবং জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দপ্তর যৌথভাবে ‘ট্রাফিকিং ইন পার্সনস ইন বাংলাদেশ’ নামে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। খবর বিবিসি বাংলা।
জেলা হিসেবে বাংলাদেশের ৭টি জেলায় সবচেয়ে বেশি মানব পাচারের ঘটনা শনাক্ত করা হয়েছে। এসব জেলা হচ্ছে মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ। এসব জেলা থেকে প্রতি লাখে দেড় জনের বেশি মানুষ পাচারের শিকার হয়।
ঢাকা, খুলনা ও সিলেট অঞ্চলের মানব পাচার চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়ার ঘটনা ঘটে খুলনা বিভাগে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের সব এলাকার বাসিন্দারাই মানব পাচারের শিকার হয়। তবে ঢাকা, খুলনা এবং সিলেট এই তিন অঞ্চলের মানুষ বেশি পাচার হওয়ার কিছু কারণ রয়েছে। যেসব এলাকার সঙ্গে ভারতের সীমান্ত বেশি সেসব এলাকায় মানব পাচারের ঘটনা বেশি ঘটে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয় খুলনা বিভাগের কথা। এই বিভাগের পশ্চিমাঞ্চলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে দীর্ঘ স্থলসীমান্ত রয়েছে এবং সেখান থেকে কলকাতাও দূরে নয়। যার কারণে ২০২০ সালে এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি মানব পাচারের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে অভিবাসন নিয়ে গবেষণার কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রামরুর পরিচালক মেরিনা সুলতানা বলেন, যেকোনো সীমান্ত এলাকা যেখানে পারাপারটা তুলনামূলক সহজ; সেখানে অনিয়মিত অভিবাসনের সঙ্গে সঙ্গে মানব পাচারের বিষয়টিও ঘটে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের কিছু এলাকা মানব পাচারের হাব বা পকেট হিসেবে কাজ করে। এসব এলাকায় মানব পাচারকারী চক্র বেশ সক্রিয় থাকে এবং তারা সেখানকার বাসিন্দাদের নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে মানব পাচার করে থাকে।’
মেরিনা সুলতানা বলেন, যেসব জেলা পকেট হিসেবে কাজ করে সেখানে দেখা যায় যে, অনেক মানুষ আগে থেকেই বিদেশে থাকে এবং তাদের দেখাদেখি অন্যরাও যেতে চায়। এসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি মানব পাচারের শিকার হয় নারীরা। উদাহরণ হিসেবে তিনি মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ এবং নরসিংদীর কথা তুলে ধরেন।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনটিতে বলা হচ্ছে, যেসব কারণে মানব পাচার হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে উন্নত জীবনের আশায় এবং আর্থিক সচ্ছলতার প্রলোভনে। প্রায় ৫১ শতাংশ মানুষ অর্থনৈতিক কারণে পাচারের শিকার হন।
অন্যদিকে ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দাদের মধ্যে সৌদি আরব থেকে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে ১১ জনকে, ভারত থেকে ৫ জনকে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ও অস্ট্রেলিয়া থেকে একজন করে বাংলাদেশিকে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। এরা সবাই মানব পাচারের শিকার হয়েছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
সিলেট বিভাগে সবচেয়ে বেশি প্রত্যাবাসন করে ফেরত পাঠানো হয়েছে সৌদি আরব থেকে। এরপর ওমান থেকে দুজন এবং ভারত থেকে একজনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
মেরিনা সুলতানা বলেন, ভালো চাকরির প্রলোভনে যারা মানব পাচারের শিকার হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা জানে না যে তারা আসলে পাচারের শিকার হচ্ছে। আর পাচারকারীরা তাদের না বলে বিদেশ নিয়ে বিক্রি করে দেয়।
যেসব বিষয় মানব পাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় তার মধ্যে রয়েছে, অর্থনৈতিক কারণ, অন্তরঙ্গ সঙ্গী যে কিনা মানব পাচারকারী, অভিবাসনের প্রলোভন, শিক্ষা এবং বিদেশি ভাষা জানার অভাব, মানসিক সমস্যা, পারিবারিক সমস্যাযুক্ত পরিবারের সদস্য হওয়া, বাবা-মায়ের যতœ না-পাওয়া শিশু এবং শারীরিক প্রতিবন্ধকতা।
‘ট্রাফিকিং ইন পার্সনস ইন বাংলাদেশ’ নামে প্রতিবেদনে বলা হয়, যারা মানব পাচারে যুক্ত থাকে, তারা আসলে অন্য কাজের তুলনায় এ কাজে বেশি অর্থ আয় সম্ভব হয় বলে এই অপরাধের সঙ্গে জড়ায়।
তাদের হিসাবে, প্রতিটি মানব পাচারের জন্য একজন পাচারকারী ৫০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ পর্যন্ত টাকা আয় করে থাকেযা প্রচলিত পেশার তুলনায় অনেক বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে যেসব দেশের প্রত্যাবাসনের চুক্তি রয়েছে, সেসব দেশ থেকে ফেরত আনা ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়।
কিন্তু যেসব দেশের সঙ্গে প্রত্যাবাসন চুক্তি নেই সেসব দেশে বাংলাদেশ থেকে কত মানুষ পাচার হয়েছে সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য এই প্রতিবেদনে নেই।
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের ভেতরেই অনেকে পাচারের শিকার হয়। এতে বলা হচ্ছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ৭৩০টি মানব পাচারের ঘটনা জানা গেছে। এ ছাড়া ২০১৭ সালে ৭৭৮টি এবং ২০১৮ সালে ৫৬১টি মানব পাচারের ঘটনা জানা যায়।
এসডব্লিউএসএস/১৫২৫
আপনার মতামত জানানঃ