দেশে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে দুর্নীতি এখনো বাধা হিসেবে কাজ করছে। হয়রানির কারণে নতুন বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। সামান্য কাজেও সরকারি কর্মকর্তারা যে পরিমাণ হয়রানি করেন, তাতে ছোট উদ্যোক্তারা তো মনোবল হারানই, বড় শিল্প উদ্যোক্তারাও বিপাকে পড়েন।
রোববার (০২ অক্টোবর) রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘সেটিং আপ আ ফ্যাক্টরি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন ব্যবসায়ী নেতারা।
তারা অভিযোগ করেন, এনবিআরের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ও অন্যান্য অফিসের কর্মকর্তারা ঘুষের জন্য ফাইল আটকে রাখেন।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) এর পরিচালক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, “এনবিআরের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা কমিশনারের নাম উল্লেখ করার পরেও ঘুষ দাবি করেন। তারা বলেন- কমিশনার আপনার বন্ধু হতে পারে, আমার নয়। ঘুষের মধ্যে থেকে আমার অংশ আমাকে দিন।”
তিনি বলেন, ঘুষ-দুর্নীতি ও হয়রানির কারণে বছরের বছর কেটে যায় একটা কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু এসব ঘুষ-দুর্নীতির পরও দেশ এত দূর এগিয়েছে শুধু ব্যবসায়ীদের সাহসের কারণে। এ দেশের ব্যবসায়ীরা এত কষ্ট করে ব্যবসা করছেন, তা পৃথিবীতে বিরল। ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে অনেকেই খারাপ মনোভাব পোষণ করেন। তিনি বলেন, অনেকেই সিন্ডিকেটকে দোষ দেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, আলুর দাম নেই। এ বিষয়ে এক মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করলে তিনি বলেন, সিন্ডিকেট করে যদি ডিমের দাম বাড়ানো যায়, তাহলে আলুর দাম বাড়ানো যায় না কেন?
এনবিআরের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ও অন্যান্য অফিসের কর্মকর্তারা ঘুষের জন্য ফাইল আটকে রাখেন।
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সিপিডির এ ধরনের ওয়েবসাইট নির্মাণের উদ্যোগ আরো আগেই নেওয়া দরকার ছিল। কারণ কীভাবে কারখানা করতে হয়, তা না জানার কারণে নতুন উদ্যোক্তারা নানা হয়রানির শিকার হন।
তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি কি এখন নাই? ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে এক মেগাওয়াট জেনারেটর বা তার ওপরে হলে রেজিস্ট্রেশন লাগবে। কিন্তু তাদের অডিট টিম এসে ৫০০ কেবির জেনারেটরের জন্যও কাগজ চায়। তারা টাকা ছাড়া নড়েই না।
তিনি দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘কিছুদিন আগে বিসিকের রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার জন্য এক ব্যবসায়ী আবেদন করে এক মাসেও সেটি পাননি। তার কাছে নাকি প্রত্যয়নপত্রের জন্য ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চাইছে। আমি বিসিকের পরিচালককে ফোন দিলে তিনি তখনই সই করে দেন। কিন্তু তার পরও কর্মকর্তারা ফাইল ছাড়েন না।’
ব্যবসায়ী নেতারা আরো বলেন, এ ধরনের দুর্নীতি দেশের ব্যবসায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে এবং স্থানীয়-বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ পরিস্থিতিতে ব্যবসা করতে পছন্দ করেন না।
লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, “আমাদের প্রধান দুশ্চিন্তার জায়গা কাস্টমস অ্যান্ড বন্ড।”
বন্ড লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ায় ভিয়েতনামের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, “সেখানে মাত্র ৪ ধরনের ডকুমেন্ট প্রয়োজন হয় এবং পাঁচ সপ্তাহে সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আমরা কেন তা করতে পারছি না?”
“অনেক সংস্কার করা হয়েছে এবং অনেক কর্মকর্তা বা কমিশনার এসেছেন, কিন্তু পরিস্থিতি একই রয়ে গেছে। ব্যবসায় সাহায্য করার পরিবর্তে যদি নিয়ন্ত্রণের মনোভাব থাকে তাহলে কোনো উদ্যোগই সফল হবে না,” যোগ করেন তিনি।
বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসানও সরকারি অফিসে শিল্পপতিরা যে হয়রানির শিকার হন তার কিছু বিষয় তুলে ধরেন।
একটা এইচএস কোড ভুল হলে ১০ দিন পণ্য বন্দরে আটকে থাকে। কর্মকর্তারা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখেন, কোথায় ভুল ধরা যায়। কারণ দেরি করাতে পারলে কী হয়, …. তা আর বলতে চাই না,” বলেন তিনি।
বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও গ্যাস সংকটের কারণে পোশাক উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সিপিডি একটি ওয়েবসাইট চালু করেছে যেখানে শিল্প মালিকরা একটি কারখানা স্থাপনের জন্য কত ধরনের নথির প্রয়োজন তা দেখতে পাবেন।
ওয়েবসাইট অনুযায়ী, তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার অন্তত ২০ ধরনের নথির প্রয়োজন হয়। ফার্মাসিউটিক্যালস, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের মতো অন্যান্য কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে আরও নথির প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম এবং জিআইজেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ড. মাইকেল ক্লোড।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১১
আপনার মতামত জানানঃ