লিথিয়াম ব্যাটারির মাধ্যমে কার্টিজে থাকা নিকোটিন, স্বাদ ও গন্ধমিশ্রিত ই-লিকুইড ও প্রপিলিন গ্লাইকল নামক রাসায়নিক পুড়িয়ে মস্তিষ্কে ধূমপানের মতো অনুভূতির সৃষ্টি করে ই-সিগারেট। গত কয়েক বছর ধরেই তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। অনেকে সিগারেটের বিকল্প হিসেবে কিংবা সিগারেট ছাড়তে হাতে তুলে নিয়েছে এই ডিজিটাল ভ্যাপিং ব্যবস্থা।
বলা হয়ে থাকে ধূমপানে আসক্তি কমাতে ও সিগারেটের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে তামাকবিহীন ই-সিগারেট তুলনামূলক ভালো সমাধান হতে পারে। কিন্তু গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা। তরুণ অধূমপায়ীদের ই-সিগারেট ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞরা।
যদিও অ্যাকশন অন স্মোকিং অ্যান্ড হেলথ (এএসএইচ) এর সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ১১ থেকে ১৮ বছর বয়সী লোকেদের মধ্যে ভ্যাপিং ২০২০ সালে ৪ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ হয়ে ২০২২ সালে ৮.৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
ই-সিগারেটের স্বাস্থ্যঝুঁকি
হিট-নট-বার্ন বা ই-সিগারেট যে নামেই অবহিত করা হোক না কেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ধরনের পণ্যকে শরীরের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট অনুযায়ী, ই-সিগারেট ব্যবহারে হার্টঅ্যাটাক, স্ট্রোক ও ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে। জাপানে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ই-সিগারেট সাধারণ সিগারেটের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ক্ষতিকারক।
হংকং কাউন্সিল অন স্মোকিং অ্যান্ড হেলথের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ই-সিগারেটে যে উপাদানগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোর মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন সেলের বিকল করাসহ ক্যান্সার হতে সাহায্য করে। ই-সিগারেটের তরল মিশ্রণের (ই-লিকুইড) মধ্যে থাকে প্রোপেলিন গ্লাইসল, গ্লিসারিন, পলিইথিলিন গ্লাইসল, নানাবিধ ফ্লেভার ও নিকোটিন।
গরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রাসায়নিকগুলো থেকে সাধারণ সিগারেটের ধোঁয়ার সমপরিমাণ ফরমালডিহাইড উৎপন্ন হয়, যা মানব শরীরের রক্ত সঞ্চালনকে অসম্ভব ক্ষতি করে।
এমন ক্ষতি সাধারণ সিগারেটেও হয় না বলে জানিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালোফোর্নিয়ার অধ্যাপক বেনোউইটজ। এ ছাড়া ই-সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে অতিসূক্ষ্ম রাসায়নিক কণা, যা মানব শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক।
এর থেকে গলা-মুখ জ্বালা, বমিভাব এবং ক্রনিক কাশি দেখা দিতে পারে। ই-সিগারেটের মধ্যে থাকা উত্তপ্ত গ্লিসারিন থেকে গঠিত একরোলিন খুব দ্রুত ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ব্যবহারকারীদের হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ই-সিগারেটে থাকা প্রোপাইলিন গ্লাইকোল কৃত্রিম ধোঁয়া তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
এটি ফুসফুস ও চোখে বিরক্তির উদ্রেক করে এবং এটি ফুসফুসের বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী। যেমন অ্যাজমা ও এমপাইসিমা। এ ছাড়া ই-সিগারেটে এরোসোল থাকে, যেটি অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এটি শরীরে শিরাগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত তো করেই, পাশাপাশি শরীরে বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং স্নায়ুর ওপর চাপ ফেলে। ই-সিগারেটের এরোসোলের ভেতরে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত বা টক্সিক ধাতু পাওয়া গেছে। যেমন টিন, নিকেল, ক্যাডিয়াম, লেড ও মারকারি।
তামাক কোম্পানির মিথ্যাচার
তামাক কোম্পানিগুলো ক্ষতি কমানো ও ধূমপান ত্যাগের উপকরণ হিসেবে হিট-নট-বার্ন বা ই-সিগারেটকে উপস্থাপন করতে চাচ্ছে। অথচ এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বরং প্রায় ৮,০০০ বিভিন্ন স্বাদ যেমন ফল, সফট ড্রিংকস, চকোলেট, পুদিনা এবং অন্যান্য বিভিন্ন ফ্লেভারে ই-সিগারেটগুলো ‘স্বাস্থ্যকর এবং ট্রেন্ডি পণ্য’ হিসাবে বাজারজাত করা হয়, যা মূলত কিশোর-কিশোরীদের কৌতূহল বাড়িয়ে তোলে এবং নেশায় আকৃষ্ট করে।
মূলত এ কাজের উদ্দেশ্য হচ্ছে– নীতিনির্ধারকদের বিভ্রান্ত করা এবং তরুণদের এই নতুন নেশার পণ্য ব্যবহার করতে উৎসাহী করা।
আন্তর্জাতিক সংস্থা দি ইউনিয়ন ‘ইউনিয়ন পজিশন পেপার অন ই-সিগারেটস অ্যান্ড এইচটিপি সেলস ইন এলএমআইসিএস’ শীর্ষক একটি পজিশন পেপার প্রকাশ করেছে। পজিশন পেপারে দ্য ইউনিয়ন উল্লেখ করেছে, ইন্ডাস্ট্রিগুলোর মূল টার্গেট হলো তরুণ প্রজন্ম।
গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো সার্ভেতে তরুণদের ই-সিগারেটে ঝুঁকে পড়ার তথ্য উঠে এসেছে। ই-সিগারেটের ব্যবহার পারতপক্ষে সিগারেট ছাড়তে সাহায্য তো করছেই না; বরং স্মোকাররা সিগারেট ও ই-সিগারেট দু’টোতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। দি ইউনিয়ন অবিলম্বের ই-সিগারেট নিষিদ্ধের সুপারিশ করেছ।
আমেরিকার সার্জেন্ট জেনারেল কর্তৃক গবেষণায় দেখা যায়, ১৮-২৪ বছরের তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেটের ব্যবহার ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালে দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে মাত্র ০.০২ শতাংশেরও কম মানুষ ই-সিগারেট ব্যবহার করে ধূমপান ছাড়তে পেরেছেন।
বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হচ্ছে ই-সিগারেট
যুক্তরাষ্ট্রে ছয়জনের মৃত্যু আর অনেকের ফুসফুসের জটিলতা ধরা পড়ার পর ভেপিং বা ই-সিগারেট ব্যবহারের ক্ষতির দিকটি আলোচনায় আসে এবং পরে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে ই-সিগারেট। বিশ্বের অনেক দেশ ই-সিগারেটের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এর ভয়াবহতা বুঝতে পেরেছে এবং ইতিমধ্যে ৪২ দেশ তাদের দেশে ই-সিগারেটকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে এবং আরও ৫৬ দেশ ই-সিগারেট ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে।
পাশাপশি আরও অনেক দেশ তাদের নিদির্ষ্ট কয়েকটি প্রদেশে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশে ই-সিগারেটের বর্তমান অবস্থা
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির গবেষণা সেল টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেলের (টিসিআরসি) গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে তরুণদের আকৃষ্ট করতে ই-সিগারেট দোকানগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক গড়ে তোলা হয়েছে। তরুণদের আকৃষ্ট করতে তারা বিভিন্ন ধরনের চটকদার বিজ্ঞাপন তৈরি করে প্রচার করছে। অথচ বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনে যে কোন ধরনের তামাকজাতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা নিষিদ্ধ।
এছাড়াও জানা গেছে, যারা ধূমপান ছাড়তে চিকিসকের পরামর্শ নিতে যাচ্ছে , দেশের অনেক চিকিৎসক তাদের প্রচলিত সিগারেটের বদলে ই-সিগারেট ব্যবহারে উৎসাহিত করছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০৫
আপনার মতামত জানানঃ