বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জোর দাবি জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, নির্বাচন যত দেরিতে হবে, ষড়যন্ত্র তত বৃদ্ধি পাবে। এ কারণে তিনি দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে। তবে, বিএনপির আন্দোলন এবং তারেক রহমানের এই অবস্থান দেশে সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে, ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্বদের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিএনপির এই দাবির প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছে। তারা মনে করে, নির্বাচন আয়োজনের আগে সংস্কারের রোডম্যাপ এবং বিচারকে দৃশ্যমান করা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, বিএনপি মনে করে, নির্বাচন বিলম্বিত হলে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা ঘোষণা করেছে। তবে, এই সময়সীমা নিয়ে বিএনপি কখনোই সন্তুষ্ট ছিল না। তারা মনে করে, সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করে সময়ক্ষেপণ করছে, যা রাজনৈতিক সংকট বাড়িয়ে তুলছে।
বিএনপির আন্দোলনের ফলে ড. ইউনূসের পদত্যাগের ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তবে, বিএনপি জানিয়েছে, তারা ড. ইউনূসের পদত্যাগ চায় না। তবে, তিনি থাকতে না চাইলে বিকল্প বেছে নেবে জনগণ।
এই পরিস্থিতি বিএনপির জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ, জনগণ স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন চায়। যদি বিএনপির আন্দোলন দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে, তাহলে জনগণের সমর্থন হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এটি বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হতে পারে।
সুতরাং, তারেক রহমানের ডিসেম্বরেই নির্বাচন চাওয়ার অবস্থান এবং বিএনপির আন্দোলন দেশে সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে। এটি ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্বদের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং বিএনপির জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে।
দেশবাসীর অনেকেই এখন বিএনপির প্রতি আগের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, সরকারে এবং বিরোধী দলে থাকার অভিজ্ঞতা, এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপির ওপর মানুষের প্রত্যাশা এখন বহুমাত্রিক ও গভীর। রাজনৈতিকভাবে সচেতন জনগণ বিএনপির কাছ থেকে চায় এমন কিছু যা অতীতে বারবার দেখা যায়নি—একটি পরিণত, দায়িত্বশীল এবং ভবিষ্যতমুখী রাজনৈতিক আচরণ।
সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা হলো গঠনমূলক বিরোধী রাজনীতি। আওয়ামী লীগের টানা ক্ষমতায় থাকার পরিপ্রেক্ষিতে, দেশে একটি কার্যকর বিরোধী দলের ঘাটতি তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। জনগণ চায় বিএনপি সেই শূন্যস্থান পূরণ করুক। শুধু সরকারবিরোধী বক্তব্য নয়, বরং বিকল্প নীতি, আইনগত বিশ্লেষণ, উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং জনকল্যাণমূলক প্রস্তাব জনগণ দেখতে চায় তাদের কাছ থেকে। সংসদে না থেকেও একটি আধুনিক বিরোধী দলের মতো আচরণ—এটাই এখন সময়ের দাবি।
জনগণের আরেকটি স্পষ্ট প্রত্যাশা হলো, রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা। এক দশক আগের আন্দোলন-অবরোধের ভয়াবহ স্মৃতি এখনো মানুষের মনে রয়েছে। ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী—সব শ্রেণির মানুষই রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে মুক্ত থাকতে চায়। তারা বিএনপির কাছ থেকে এমন কর্মসূচি প্রত্যাশা করে, যা হোক শান্তিপূর্ণ, আইনসঙ্গত ও জনজীবনকে অচল না করে।
একই সঙ্গে মানুষ চায় একটি স্বচ্ছ, ইতিবাচক রোডম্যাপ। ‘সরকার পদত্যাগ করুক’—এ ধরনের স্লোগানের বাইরে বিএনপি কীভাবে দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতে চায়, কোন খাতে কী রকম সংস্কার আনতে চায়, সেসব বিষয়ে পরিস্কার ধারণা দেয়ার দাবি রয়েছে জনগণের মধ্যে। অনেকেই মনে করে, শুধু সরকারের সমালোচনা নয়—নিজেদের বিকল্প নীতিমালা না জানালে বিএনপি জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হবে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা হলো রাজনৈতিক ঐক্য এবং সমঝোতার মানসিকতা। মানুষ এখন বোঝে, কোনো দল এককভাবে দেশ চালাতে পারবে না। তাই অনেকেই চায় বিএনপি এমন কৌশল গ্রহণ করুক যাতে বিরোধী রাজনীতি কেবল কনফ্রন্টেশনে আটকে না থেকে আলোচনার পথে অগ্রসর হয়। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা বা জাতীয় সংলাপের প্রশ্নে নমনীয়তা ও বাস্তবসম্মত প্রস্তাব দেখতে চায় জনগণ।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও বিএনপি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। অনেক তরুণ নেতৃত্ব ও নতুন চিন্তাধারার অভাবকে দুর্বলতা হিসেবে দেখছে, আবার কেউ কেউ চায় বিএনপি আরও আধুনিক হোক—সংগঠনের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়াক, ডিজিটাল মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলুক এবং বয়োজ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের পাশাপাশি নতুন মুখ সামনে আনুক।
অর্থনৈতিক সংকট ও আন্তর্জাতিক চাপের এই সময়ে, দেশের মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা, স্থিরতা এবং কর্মপরিকল্পনা চায়। বিএনপির ওপর সেই দায়িত্ব বিশেষভাবে বর্তায়, কারণ তারা ক্ষমতার বিকল্প দাবিদার। কিন্তু আন্দোলনের কৌশল, তারেক রহমানের দূরবর্তী ভূমিকা, বা সাংগঠনিক দুর্বলতা—এসব নানা কারণে সেই প্রত্যাশা পূরণ অনেক সময়েই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
তবে এখনো সময় আছে। বিএনপি যদি সংযত, পরিকল্পিত ও বাস্তবধর্মী রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে, তাহলে জনগণের প্রত্যাশার জায়গাটা তারা পুনরুদ্ধার করতে পারে। দেশের মানুষ বিএনপির কাছ থেকে শুধু সরকারবিরোধী স্লোগান নয়, একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে চায়—যেখানে আছে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও জাতীয় ঐক্যের আশা। এখন বিএনপির হাতে সেই আস্থার সুযোগ। প্রশ্ন হলো, তারা তা কীভাবে কাজে লাগাবে?
আপনার মতামত জানানঃ