দেশের কৃষিখাতে বিনিয়োগ ও অংশীদারি বাড়াতে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ভারতীয় উদ্যোক্তা এবং সে দেশের সরকারের প্রতি আহবান জানানো হচ্ছে। ভারত সরকারের প্রতিনিধিরা তাতে সাড়াও দিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের কৃষিখাতে ভারতের আধিপত্য সৃষ্টির শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কৃষিখাতে ভারতের বিনিয়োগ বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তাদের ওপর কী প্রভাব ফেলবে সে বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা ও অনুসন্ধান নেই। যথাযথ সমীক্ষা ও অংশীজনদের মতামত না নিয়ে সরকার এমন পদক্ষেপ নেয়ায় বিঘ্নিত হতে পারে জাতীয় স্বার্থ।
চলতি মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সামিট উপলক্ষে মোট ৭টি চুক্তি/সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এরই অংশ হিসাবে গত ১৭ ডিসেম্বর ২০২০, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কৃষিক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা সম্পর্কিত স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক নবায়ন হয়েছে। এই সমঝোতা স্মারকের আওতায় কৃষি গবেষণা, প্রাণিসম্পদ, পোল্ট্রি ও মৎস্য খাতের উন্নয়নে গবেষণা, উৎপাদন ও রোগপ্রতিরোধ, কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি সমবায়, পাট উৎপাদন ও চাষাবাদ, বীজ উৎপাদন ও বিতরণ, বালাই ব্যবস্থাপনা, বায়োটেকনোলজি, কৃষি শিল্পে যৌথ উদ্যোগ, প্রশিক্ষণ ও তথ্য বিনিময়, যৌথ প্রকাশনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের পারস্পরিক সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে।
সমঝোতা নবায়নের এক সপ্তাহ না পেরোতেই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও অ্যাগ্রোপ্রসেসিংয়ে বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিনিয়োগ করতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। কৃষি খাতে ভারত-বাংলাদেশের পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে দু’দেশের ২২ ডিসেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার এক ডিজিটাল কনফারেন্সে তিনি এ আহ্বান জানান। রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই অডিটরিয়ামে এ কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) এবং কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (সিআইআই) যৌথভাবে এ কনফারেন্সের আয়োজন করে।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ কৃষি যান্ত্রিকীকরণের দিকে যাচ্ছে। সরকার এ বছর ২০০ কোটি টাকার মাধ্যমে ৫০-৭০% ভর্তুকিতে কৃষকদের কম্বাইন্ড হারভেস্টার, রিপারসহ কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে। এছাড়াও ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যার মাধ্যমে প্রায় ৫১ হাজার কৃষি যন্ত্রপাতি দেওয়া হবে। বাংলাদেশে কৃষি যন্ত্রপাতির বাজার বছরে প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলারের। যা বছরে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এ বিশাল বাজারে ভারত যদি সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিনিয়োগে করে তবে দু’দেশই উপকৃত হবে।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, আমরা কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণে আর সহযোগিতা দেখতে চাই। ভারতীয় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট স্থাপন করতে পারে। ভারত বীজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে বাংলাদেশ স্বাগত জানাবে।
কৃষিমন্ত্রী বীজ রফতানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে জোরদার অবস্থান না নিলেও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি অবশ্য বাংলাদেশি রফতানি পণ্যের ওপর আরোপিত অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্কের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ভারত শুধু আমাদের প্রতিবেশী নয়, ভালো বন্ধুও বটে। ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। তবে বাণিজ্য ভারসাম্য এখনো ভারতের অনুকূলে। কিন্তু ভারতের অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্কের কারণে আমাদের রফতানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা তা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাই।
বাংলাদেশের দুই দাবি, বীজ রফতানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা ও বাংলাদেশি রফতানি পণ্যের ওপর আরোপিত অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে কনফারেন্সে কোনো ইতিবাচক প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। তবে ভারতের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল জানান যে, সে দেশের সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের কৃষির সকল ক্ষেত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী।
পীযূষ গয়াল বলেন, ভারত-বাংলাদেশ দুদেশেই ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ কৃষিতে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। এ অংশীদারিত্ব অন্যদের জন্য রোল মডেল। আমি মনে করি, দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারে কৃষির গেম চেঞ্জিং সম্ভাবনা রয়েছে। ভারত বাংলাদেশে কৃষিযান্ত্রিকীকরণ, ফুড প্রসেসিং ও ফিস-অ্যাকুয়াকালচার এই তিনটি খাতে অধিক গুরুত্বসহ কৃষির সকল ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও সহযোগিতা করতে আগ্রহী।
কনফারেন্সের দুটি পৃথক বিটুবি সেশনের আলোচনায় দু’দেশের কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী, কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী ও খাদ্যপ্রক্রিজাতকরণ খাতের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এতে আরও বক্তব্য দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, এফবিসিসিআই’র সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী, টাটা স্টিলের সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক টি ভি নরেন্দ্রন, মাহিন্দ্র ও মাহিন্দ্রর সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পবন গোয়েঙ্কা প্রমুখ। এ সময় কৃষিসচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এবং দুদেশের ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি। কৃষিখাতে এ দেশের মানুষের রয়েছে হাজার বছরের অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের কৃষির রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও নিজস্ব বিকাশের ধারা। এখানে বাইরের হস্তক্ষেপ কৃষিকে বরাবরই সংকটের মুখে ফেলেছে। অতি উৎপাদনের লক্ষ্যে বাংলাদেশে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। যার ফলে আজ সাধারণ কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে, ভোক্তারাও তার দায় মেটাচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশের কৃষিকে মুনাফামুখী বাজারের দিকে ঠেলে দেবে। তা না করে কৃষিকে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা ও শিল্পের কাঁচামালের উৎস হিসেবে গড়ে তোলা দরকার। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগই হতে পারে এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো সমাধান।
এসডাব্লিউ/এসএন/আরা/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ