বিগত তিন দশক ধরে মায়ানমার সরকারের সহিংস নির্যাতন থেকে ৩ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে অবস্থান করছে। ২০১৭ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা শুরু হওয়া গণহত্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রায় সাড়ে ছয় লক্ষ থেকে ৭ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বিভিন্ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালের এপ্রিলে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লাখ ৩ হাজার ২৭২ জন। ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে এক দশমিক এক মিলিয়ন (১১ লাখ) রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে।
অন্যদিকে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছিল, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৩২ হাজার। শুধু ইউএনএইচসিআর নয়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ লাখ ৫৭ হাজার রোহিঙ্গার হিসাব দিয়েছিল বিভিন্ন ক্যাম্পে জরুরি সহায়তার কাজে থাকা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত গ্রুপ ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপও (আইএসসিজি)।
এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যায়নি। এদিকে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গার ঢল নামার পর আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশে ২০১৮ সালে ৪৮ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নেবে বলে তথ্য দিয়েছিল। আর ইউনিসেফের তথ্য বলছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে ৬০টি রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে। এবং বিগত তিন বছরে শিশু জন্মেছে ৭৬ হাজার। সে হিসাবেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ার কথা এখন।
অথচ সম্প্রতি প্রকাশিত ইউএনএইচসিআরের এক প্রতিবেদন বলছে, গত দুই বছরে বাংলাদেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উল্টো কমেছে ৭৭ হাজার ৫১৪ জন।
রোহিঙ্গাদের বড় অংশ উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা নীরব। অন্যদিকে, সরকারি কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকেই অস্বীকার করেছেন।
সচেতন নাগরিক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা স্থানীয় বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, অনেকেই চিরদিনের জন্য ক্যাম্প ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকেই আবার নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে থাকেন।
জানা যায়, কাজের জন্য রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে চলে যাওয়া একটি ‘ওপেন সিক্রেট’। অনেক রোহিঙ্গাই ক্যাম্প ছেড়ে চলে গেছেন। যাদের আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভালো, তারা কক্সবাজারে বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকছেন। যারা সক্ষম ছিলেন তারা বিদেশে গেছেন। তবে, এরকম শরণার্থীর সংখ্যা কেবল কয়েক হাজার পর্যন্ত হতে পারে। রোহিঙ্গারা প্রায় এক বা দুই মাস পর্যন্ত টানা ক্যাম্পের বাইরে ঘুরতে যান বলেও জানা যায়। কয়েকজন রোহিঙ্গা স্থানীয়দের বিয়েও করেছেন এবং চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের অন্যান্য অংশ ও বান্দরবানে থাকতে শুরু করেছেন। ক্যাম্প ছেড়ে আসা শরণার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই মাছ ধরার ট্রলার ও নির্মাণ সাইটে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন বলে জানা গেছে।
বান্দরবানে প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা পরিবার বসতি স্থাপন করেছে বলে জানা যায়। গত সাত থেকে আট বছর ধরে প্রায় চার শ পরিবার আলীকদম উপজেলায় বসতি স্থাপন করেছে। এমনকি আলীকদমে বার্মাইয়া (বার্মিজ) পাড়া নামে একটি গ্রামও আছে। বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উক্যনু মারমা বলেন, ‘২০০৭-০৮ সালের আগে এখানে কোনো রোহিঙ্গা পরিবার ছিল না। তবে, এখন এই ইউনিয়নে দুই শটিরও বেশি রোহিঙ্গা পরিবার বসবাস করছে। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০টি রোহিঙ্গা পরিবার ভোটার তালিকায়ও নিবন্ধিত আছে বলে জানান তিনি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারী ও শিশুরা প্রায়ই পাচারকারীদের সহায়তায় সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের কাছে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার সময় এমনই একটি নৌকা কমপক্ষে ১৪ জন রোহিঙ্গাসহ ডুবে যায়। নৌকাটিতে সবাই নারী ও শিশু ছিলেন। মে মাসে রোহিঙ্গাদের বহনকারী একটি নৌকা মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে না পেরে বাংলাদেশে ফিরেছিল। এই বছরের শুরুর দিকে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমুদ্রে আটকে থাকা এমন বেশ কয়েকটি জাহাজের একটিকে নৌবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার করেন।
এসডব্লিউ/কেএইচ/২২১০
আপনার মতামত জানানঃ