দেশে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৩৬৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। স্কুলশিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ১৯৪ জন স্কুলশিক্ষার্থী। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্যটি প্রকাশ করেছে সংগঠনটি। স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এ জরিপটি করা হয়।
জরিপে দেখা গেছে, স্কুলশিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ১৯৪ জন স্কুলশিক্ষার্থী। প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ১৪-১৬ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। জরিপ অনুযায়ী এ বয়সী আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা ১৬০। ৭ বছরের এক শিশুও আত্মহত্যা করেছে।
জরিপে আরও বলা হয়, গত আট মাসে মোট আত্মহননকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০ জন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে ছেলে ৬০ শতাংশ এবং মেয়ে ৪০ শতাংশ। কলেজপড়ুয়াদের মধ্যে ৭৬ জন এ পথ বেছে নিয়েছে, যার মধ্যে ৪৬.০৫ শতাংশ ছেলে এবং ৫৩.৯৫ শতাংশ মেয়ে। সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৯৪ জন স্কুলগামী শিক্ষার্থী গত আট মাসে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩২.৯৯ শতাংশ ছেলে এবং ৬৭.০১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। মাদ্রাসাপড়ুয়া ৪৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবনাবসানের পথ বেছে নিয়েছে। তার মধ্যে ৩৯.২৯ শতাংশ ছেলে এবং ৬০.৭১ শতাংশ মেয়ে।
শিক্ষা স্তর বিবেচনায় আত্মহননকারীদের মধ্যে বিদ্যালয়গামী অর্থাৎ প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রী রয়েছেন ৫৩.৩০ শতাংশ। আত্মহত্যার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা, যা ২০.৮৮ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থী রয়েছে ১৩.৭৪ শতাংশ। আত্মহননকারীদের মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছেন শতকরা ১২.০৯ শতাংশ।
আত্মহত্যায় এবারও এগিয়ে আছে মেয়ে শিক্ষার্থীরা, যা মোট আত্মহননকারীদের ৬০.৭১ শতাংশ বা ২২১ জন। অন্যদিকে ছেলে শিক্ষার্থী রয়েছেন ৩৯.২৯ শতাংশ বা ১৪৩ জন।
আত্মহত্যার ঘটনা অনুসন্ধানে আঁচল ফাউন্ডেশনের তরুণ গবেষকরা আত্মহননের পেছনের বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে জানতে পারেন। এরমধ্যে যে কারণগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সেগুলো হলো— অভিমান, প্রেমঘটিত কারণ, সেশনজট, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, পড়াশোনার চাপ, পরিবার থেকে কিছু চেয়ে না পাওয়া, পারিবারিক কলহ, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, চুরি বা মিথ্যা অপবাদ, মানসিক সমস্যা, বিয়েতে প্রত্যাখ্যাত, স্বামী পছন্দ না হওয়া, বাসা থেকে মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়া ইত্যাদি। আরও রয়েছে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, বিষণ্নতা, বন্ধুর মৃত্যু, আর্থিক সমস্যার মতো বিষয়ও।
প্রাপ্ত উপাত্ত অনুসারে, সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ২৫.২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেন। অভিমান করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ২৪.৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। পরিবারের সঙ্গে চাওয়া পাওয়ার অমিল হওয়ায় ৭.৪২ শতাংশ এবং পারিবারিক কলহের কারণে ৬.৫৯ শতাংশ আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ৪.৬৭ শতাংশ। মানসিক সমস্যার কারণে এই পথে ধাবিত হন ৬.৫৯ শতাংশ।
তাছাড়া পড়াশোনার চাপে ০.৮২ শতাংশ, সেশনজটের কারণে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ০.৮২ শতাংশ এবং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় ১.৯২ শতাংশ আত্মহননের দিকে যান। ১.৬৫ শতাংশ চুরির মিথ্যা অপবাদে, ১.৯২ শতাংশ আর্থিক সমস্যায়, ০.৫৫ শতাংশ বন্ধুর মৃত্যুতে বিষাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এছাড়াও বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় এবং স্বামী পছন্দ না হওয়ায় ১.১০ শতাংশ। তবে ১৫.৯৩ শতাংশের আত্মহননের কারণ জানা যায়নি।
সাত বছরের একজন যার আত্মহত্যা বোঝার মতো বয়সও হয়নি, তার আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলোও বিশ্লেষণ করে শিশু অবস্থা থেকেই শিক্ষার্থীদের মনোবল শক্ত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
আত্মহননকারী কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহত্যার পূর্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের মানসিক অবসাদ কিংবা বিদায় নেওয়ার কথা জানান দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তাদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যা করেন আট জন এবং ভিডিও কলে এসে আত্মহত্যা করেন দুই জন। আর সেলফি ক্যামেরা নিজের দিকে তাক করে আত্মহত্যা করেন ০.২৭ শতাংশ প্রেমিক যুগল। এছাড়া মৃত্যুর আগে চিরকুট বা সুইসাইড নোট লিখে আট জন আত্মহত্যা করেছেন।
আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও মোবাইলে ধারণের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন চার জন শিক্ষার্থী।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা দেখেছি শিক্ষার্থীরা পরিবার থেকে কোনো কিছু না পেয়ে অভিমান করেও আত্মহত্যা করেছেন। মোটরসাইকেল, মোবাইল চেয়ে না পাওয়ার কারণে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। প্রত্যাশা পূরণ না হলে কীভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সে বিষয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক বড় ধরনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের অনেক বড় ধরনের প্রকল্প হাতে নিতে হবে। সাত বছরের একজন যার আত্মহত্যা বোঝার মতো বয়সও হয়নি, তার আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলোও বিশ্লেষণ করে শিশু অবস্থা থেকেই শিক্ষার্থীদের মনোবল শক্ত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
তাসনিম রোজ আরও বলেন, করোনার সময়ে দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকার ফলে অনেকের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন এসেছে। রাগ বেড়েছে, মানসিকভাবে সহজেই ভেঙে পড়ার হারও বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে পড়াশুনার চাপও। এছাড়াও পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যাও বেড়েছে আগের চেয়ে। আমাদের শিক্ষার্থীরা সবকিছু একসঙ্গে সামাল দিতে পারছে না বলেই তুলনামূলক আত্মহত্যার হার বেড়েছে, যেখানে আমরা আশা করেছিলাম করোনার পর আত্মহত্যা প্রবণতা কমে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, বর্তমানে দেখা যাচ্ছে আত্মহত্যার ঘটনাগুলো অত্যন্ত আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বিশেষ করে কম বয়সী স্কুলগামী থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, স্কুলগামী আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৬০ শতাংশেরও বেশি। এই হার এত উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে কোন কারণগুলো আছে তা খুঁজে বের করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা এখন যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে আত্মহত্যা না করলেও তাদের অন্যান্য মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, পেশাজীবীদেরও এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা উচিত এবং কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে বিষয়ে সমন্বিত কাজ করা প্রয়োজন। এছাড়াও সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৮
আপনার মতামত জানানঃ