বাংলাদেশ জাতীয় দলের বেশ কয়েকজন তারকা ক্রিকেটাররা একের পর এক জড়িয়েছেন নারী নির্যাতনের কেলেঙ্কারিতে। রুবেল হোসেন, নাসির হোসেন, আরাফাত সানি, সাব্বির রহমান, মোহাম্মদ শহীদের পর এবার নারী নির্যাতনের কেলেঙ্কারিতে জড়ালেন টাইগার ক্রিকেটার আল-আমিন।
নির্যাতন ও বাচ্চাসহ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের পেসার আল-আমিন হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তার স্ত্রী ইসরাত জাহান। গত বৃহস্পতিবার তিনি লিখিত অভিযোগ করলে গতকাল শুক্রবার তা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। তবে ঘটনার পর পালিয়েছেন আল-আমিন, তাকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ।
পেসার আল আমিন ২০২০ সালে সর্বশেষ খেলেছেন জাতীয় দলে। এরপর ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজেকে ব্যস্ত করেছেন ৩২ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। জাতীয় দলে খেলার সময়ও শৃংখলা ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছিল আল আমিনের বিরুদ্ধে। এ কারণে ২০১৫ সালের অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ থেকে দেশেও ফেরত পাঠানো হয় তাকে। নতুন করে ফের বিতর্কে জড়ালেন তিনি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সোহেল রানা বলেন, মিরপুর ২ নম্বর সেকশনের ২ নম্বর রোডের ১০ নম্বর প্লটের নয় তলা ভবনের ৭/ডি নম্বর ফ্ল্যাটে আল আমিন সপরিবারে থাকেন। ওই ফ্ল্যাটের মালিক আল আমিন। তবে ফ্ল্যাটের মূল্য বাবদ ৩০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। আল আমিনের দুই ছেলে সন্তানের বয়স যথাক্রমে ৬ ও ২ বছর। ওই ফ্ল্যাটে আল আমিনের স্ত্রী ও দুই সন্তান বর্তমানে থাকছেন। তবে তাকে গ্রেপ্তারের জন্য আমাদের অভিযান চলছে।
বৃহস্পতিবার অভিযোগ দায়েরের পর গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে ইসরাত জাহান বলেছিলেন, ‘সে অন্য মেয়ে নিয়ে থাকে, ২৫ আগস্ট আমাকে মারধর করেছে। তাই অভিযোগ দায়ের করেছি থানায়। তবে আমি আপস করতে চাই, আবারও সংসার করতে চাই।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সোহেল রানা বলেন, ২৫ আগস্ট ক্রিকেটার আল আমিন তার স্ত্রীকে মারধর করে ফ্ল্যাট থেকে বের করে দিতে চেষ্টা করেন। ইসরাত জাহান অভিযোগ করেছেন, ওই ফ্ল্যাটের মূল্য পরিশোধের জন্য তার বাবার বাসা থেকে ২০ লাখ টাকা আনতে বলেন। ২০ লাখ টাকা না দিলে তাকে ফ্ল্যাটে থাকতে দেওয়া হবে না।
অন্য মেয়ের সঙ্গে আল-আমিনের সম্পর্কের বিষয়ে ইসরাত জাহান বলেন, ‘ওই মেয়ের সঙ্গে আল-আমিনের বিয়ে হয়েছে কি না, তা জানি না। কাবিননামাও পাইনি। তবে ওই মেয়ের সঙ্গে আল-আমিনের অনেক ছবি আছে।’
তিনি বলেন, ‘দুটো বাচ্চা নিয়ে আমি এখন কোথায় যাবো? আমার এখন একটাই চাওয়া, বাচ্চাদের নিয়ে যেন ভালোভাবে সংসার করতে পারি।’
ইসরাত জাহানের মামা মো. সাঈদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, দুই বছর ধরে ক্রিকেটার আল-আমিন হোসেন আমার ভাগনিকে নির্যাতন করতেন। এর আগেও থানায় নির্যাতনের অভিযোগে জিডি করা হয়েছিল। গত ২৫ আগস্ট মারধর করে বাসা থেকে বাচ্চাসহ ইসরাতকে বের করে দেন। এরপর মিরপুর থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ করেন ইসরাত।
ব্যক্তিগত’, ‘পারিবারিক’ বলে এড়ানোর চেষ্টা অনেক হয়েছে৷ একের পর এক ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে ব্যতিক্রমই যে নিয়ম হয়ে যাচ্ছে! ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনের কেলেঙ্কারি ক্রিকেটকেই কাঁপিয়ে দিচ্ছে বারবার৷
নারী নির্যাতনের মামলায় বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দল বরাবরই কলঙ্কিত হয়েছে।
এর আগে ক্রিকেটার মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ এনে মামলা করেছিলেন স্ত্রী শারমিন সামিরা ঊষা। দশ লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে নির্যাতন করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল জাতীয় দলের এই ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে।
তার আগে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় জড়িয়ে আলোচনায় এসেছিলেন রুবেল হোসেন, আরাফাত সানি, সাব্বির রহমান, নাসির হোসেন আর মোহাম্মদ শহীদ।
ব্যক্তিগত’, ‘পারিবারিক’ বলে এড়ানোর চেষ্টা অনেক হয়েছে৷ একের পর এক ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে ব্যতিক্রমই যে নিয়ম হয়ে যাচ্ছে! ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনের কেলেঙ্কারি ক্রিকেটকেই কাঁপিয়ে দিচ্ছে বারবার৷
ঘটনা পরিবারের গন্ডি পেরিয়ে মিরপুরে বিসিবির সুরম্য অট্টালিকার দেয়ালেই সীমাবদ্ধ থাকেনি৷ এ সূত্র ধরে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করা তিন-তিনজন ক্রিকেটারের জেল পর্যন্ত ঘুরে আসতে হয়েছে৷
কেলেঙ্কারির শুরু রুবেল হোসেনের মাধ্যমে৷ এই পেসারের বিপক্ষে চিত্রনায়িকা নাজনীন আক্তার হ্যাপী ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে মামলা করেন বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার সঙ্গে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগে৷ মামলার জের ধরে জেলে যেতে হয় রুবেলকে৷ ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপের জন্য দেশ ছাড়ার আগে নিতে হয় আদালতের অনুমতি৷ পরবতর্তীতে হ্যাপীর করা মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তি পান রুবেল৷ সেটি আদালতের রায়৷ কিন্তু জনতার রায়ে ক্রিকেট ঠিকই হয় কলুষিত৷
বাঁ হাতি স্পিনার আরাফাত সানীর বিপক্ষে নাসরিন সুলতানা নামে একজন মামলা করেন ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি৷ মামলাটি তথ্যপ্রযুক্তি আইনে৷ ওই তরুণীর দাবি, ২০১৪ সালে সানির সঙ্গে তার বিয়ে হয়৷ পরবর্তীতে এই ক্রিকেটার আরেকজনের সঙ্গে সংসার করেন৷ নাসরিনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু ছবি ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে তাকে সানি পাঠান বলে অভিযোগ৷ সেসব ছবি অন্তর্জালে ছড়িয়ে দেবার হুমকিও দেন৷ এসব কারণেই মামলা৷ সানি গ্রেপ্তার হন ওই বছরের ২২ জানুয়ারি৷ তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলার পর যৌতুক এবং শিশু ও নারী নির্যাতনের আরো দুটি মামলা করা হয় তার বিরুদ্ধে৷ ৫৩ দিন কারাগারে থাকার পর ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ অবশেষে জামিনে মুক্তি পান সানি৷ কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের আরেক কালো অধ্যায় ততদিনে রচিত হয়ে গেছে৷
জেলের চার দেয়ালে যাওয়া তৃতীয় ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন৷ শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলায় এই পেসার ও তার স্ত্রী জেসমিন জাহানের বিপক্ষে মামলা হয় ২০১৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর৷ দুজন আত্মগোপনে চলে যান৷ স্ত্রীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ৪ অক্টোবর৷ পরদিন, অর্থাৎ ৫ অক্টোবর শাহাদাত আদালতে আত্মসমর্পন করে জামিন চান৷ আদালত জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়৷ জামিন হয় ৮ ডিসেম্বর, যার অর্থ, দুই মাসের বেশি সময় শাহাদাতকে থাকতে হয়েছে জেলে৷ ওই শিশু গৃহকর্মীর পরিবারের সঙ্গে ‘সমঝোতায়’ পরবর্তীতে রক্ষা পান এ ক্রিকেটার৷ ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর মামলা থেকে অব্যাহতি মেলে শাহাদাতের৷
শুধু বিবাহিত জীবনে নয়, এমনিতেও ‘গুরুতর শৃঙ্খলাবহির্ভূত কর্মকাণ্ড’তে ক্রিকেটারদের নাম জড়িয়েছে বারবার৷ যে কারণে ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে দেশে ফেরত পাঠানো হয় আল আমিন হোসেনকে৷
২০১৬-র বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) চলার সময়ে তাকে ও সাব্বির আহমেদকে করা হয় মোটা অঙ্কের জরিমানা৷ চট্টগ্রামে নিজেদের হোটেল কক্ষে ‘নারী অতিথি’ নিয়ে রাত্রিযাপন করার অপরাধে৷ সিসি টিভির ফুটেজে এর অকাট্য প্রমাণ পেয়ে আল আমিনকে বিপিএল চুক্তির ৫০ শতাংশ এবং সাবি্বরকে ৩০ শতাংশ জরিমানা করা হয়, অর্থের অঙ্কে যা যথাক্রমে প্রায় ১২ লাখ ও ১৩ লাখ টাকা৷ বিসিবি অবশ্য দুজনের ‘অপরাধ’ প্রকাশ্যে আনেননি৷ তবে তা কারো জানতেও বাকি থাকেনি৷
একের পর এক এমন ঘটনায় প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটে৷ প্রবলভাবেই পড়ছে৷ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্রিকেটারদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কী হওয়া উচিত? ক্রিকেট৷ কিন্তু একের পর এক ঘটনা দেখে তো মনে হচ্ছে না যে, ক্রিকেটটা ওদের মূল মনোযোগের জায়গা৷
তারা বলেন, ক্রিকেটারদের বহু মানুষই অনুসরণ করে থাকেন। তারা সমাজের আইকন, তারকা, তাদের এমন কর্মকাণ্ডে সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। জাতির মেধাবীদের এহেন কাণ্ডে কেবল ক্রিকেট বোর্ড কলঙ্কিত হয় না, কলঙ্কিত হয় দেশও। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩৭
আপনার মতামত জানানঃ