দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই নির্যাতন নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সবথেকে কম কথা বলা হয়। এর কারণ হয়তো সেক্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক ভুক্তভোগী এবং ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মানুষের অন্ধবিশ্বাস। একইসাথে শারীরিক নির্যাতনগুলোও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আড়ালে থেকে যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় এবার ঢাকার সাভারে একটি মাদ্রাসার শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক শিশু শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।
সাভারের বাইপাইল বসুন্ধরা এলাকার দারুল কুরআন তালিমুল ইসলাম মাদ্রাসায় বুধবার(১৭ আগস্ট) সন্ধ্যায় ১০ বছরের শিশুটিকে পিটিয়ে জখম করলেও ঘটনাটি তার বাবা জেনেছেন পরদিন বৃহস্পতিবার(১৮ আগস্ট)।
শুক্রবার(১৯ আগস্ট) দুপুরে ভুক্তভোগী মাদ্রাসাছাত্রের বাবা সংবাদমাধ্যমকে জানান, তার ছেলেকে বেধড়ক পেটানোর পর শিক্ষকরা নিজেরাই হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করান। বৃহস্পতিবার ঘটনা জানতে পেরে ছেলেকে বাসায় নিয়ে যান। এরপর থানায় গেলেও অভিযোগ নেয়নি পুলিশ। বলেছে, নিজেরাই মিলমিশ করতে।
ভুক্তভোগী শিশুর বাবা মো. মাসুদ বলেন, ‘সাত দিন হলো আমার ছেলেকে বসুন্ধরা এলাকার হাবিবুর রহমান হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করাই। বুধবার সন্ধ্যায় হাবিবুর হজুর আমার ছেলেকে পড়া জিজ্ঞাসা করেন। পড়া না পারায় বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মারধর করেন হুজুর। পরে তারা আমার ছেলেকে চিকিৎসাও করান। বিষয়টি জানতে পেরে মাদ্রাসা থেকে আমার ছেলেকে বৃহস্পতিবার বাড়িতে নিয়ে আসি।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘গতকাল রাতে থানায় গিয়েছিলাম অভিযোগ করতে। তখন ডিউটি অফিসার ও এলাকার লোকজন ঘটনা মিলমিশ করতে বলেন। পরে আজ (শুক্রবার) ভাইস চেয়ারম্যানের অফিসে মীমাংসার জন্য আসছি।’
অভিযুক্ত শিক্ষক হাবিবুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘বুধবার সন্ধ্যায় ছেলেটা মাদ্রাসার পাশে বিদ্যুতের খুঁটি বেয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। তখন একজন তাকে দেখে ধরে নিয়ে আসে। রাগের মাথায় তাকে পাঁচ-সাতটা বাড়ি দেয়া হয়েছে। কারণ একটা বিপদ হতে পারত। পরে গতকাল রাতে ওই ছেলের বাবা-মা এসে মাদ্রাসা থেকে তাকে নিয়ে গেছে। বিষয়টা মীমাংসার জন্য ভাইস চেয়ারম্যান শাহাদাত ভাইয়ের অফিসে আসছি।’
তবে শিশুটির বাবা থানায় অভিযোগ না নেয়ার যে দাবি করেছেন, তা অসত্য বলছেন আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল আউয়াল।
সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘গতকাল রাতে মারধরের অভিযোগ নিয়ে ওনারা আসছিলেন। ওনারা জিডির কপি নিয়েছিলেন লেখার জন্য। তারপর সেটা জমা না দিয়েই চলে গেছেন। তবে তারা এখন এলে অভিযোগ নিব।’
কপি জমা না দিয়ে কীভাবে ভুক্তভোগীরা চলে গেল? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অনেক লোকজন ছিল। অত খেয়াল করতে পারিনি।’
ভুক্তভোগীকে আইনি সহায়তা না দিয়ে মীমাংসার পরামর্শ কেন দিয়েছেন- জানতে চাইলে সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
সাত দিন হলো আমার ছেলেকে বসুন্ধরা এলাকার হাবিবুর রহমান হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করাই। বুধবার সন্ধ্যায় হাবিবুর হজুর আমার ছেলেকে পড়া জিজ্ঞাসা করেন। পড়া না পারায় বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মারধর করেন হুজুর।
এদিকে খুলনার পাইকগাছায় দুপুরে না ঘুমিয়ে মাঠে খেলতে যাওয়ার অপরাধে মাদ্রাসাছাত্রকে বেত্রাঘাত করে গুরুতর আহত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আহত ছাত্র চাঁদখালী সামছুল উলুম কওমি মাদ্রাসার মাওলানা বিভাগের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র গোলাম রাব্বি (১৭)।
গত ১৪ আগস্ট তাকে বেত্রাঘাত করে আহত করেছেন মোহতামিম (ভারপ্রাপ্ত) অয়েজ আহম্মেদ।
দেশে বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিশু শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনা নতুন নয়। প্রায়শ মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তুচ্ছ কারণে শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগ ওঠে।
বাংলাদেশের আইনে ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ৷ ২০১১ সালে হাইকোর্টের এক আদেশের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে৷ আর তাতে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির সংজ্ঞাও দেয়া হয়েছে৷ শারীরিক শাস্তি বলতে যেকোনো ধরনের দৈহিক আঘাত বলা হয়েছে৷ মারধর ছাড়াও আইনে কান ধরা, চুল টানা, বেঞ্চের নিচে মাথা রাখতে বাধ্য করাও দৈহিক শাস্তি৷ আর মানসিক শাস্তির মধ্যে শিশু বা তার পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বাজে মন্তব্য বা যেকেনো আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি৷
এতে বলা হয়, হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, শিক্ষার্থীর দিকে চক বা ডাস্টারজাতীয় বস্তু ছুড়ে মারা, আছাড় দেয়া ও চিমটি কাটা, কামড় দেয়া, চুল টানা বা চুল কেটে দেওয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল চাপা দিয়ে মোচড় দেয়া, ঘাড় ধাক্কা, কান টানা বা উঠবস করানো, চেয়ার, টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, রোদে দাঁড় করিয়ে বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে এমন কোনো কাজ করানো, যা শ্রম আইনে নিষিদ্ধ৷
এই পরিপত্রে শাস্তির কথাও বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ শিশুদের শারীরিক শাস্তি দিলে ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি হবে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷
শিক্ষা মন্ত্রণালয় শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের শাস্তি দেয়াকেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেছে৷ যাদের বিরুদ্ধে এই অপরাধ প্রমাণ হবে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ একই সঙ্গে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে৷
কিন্তু এরপরও বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়ার প্রবণতা বেশ লক্ষ করা যায়৷ বিশেষ করে মাদ্রাসায় এটা প্রকট৷
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘মাদ্রাসাশিক্ষকদের সেভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। এ কারণে তারা শিশুদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সেটা জানে না। আর মাদ্রাসায় যেসব অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠায় তারাও সচেতন না। এ কারণে নির্যাতন হলেও তারা তেমন কিছু বলে না। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে ছাত্র নির্যাতনের একটি পরিবেশ অনেক দিন থেকেই চলে আসছে।’
এভাবে পেটানোর পেছনে শিক্ষকদের মানসিকতাই দায়ী বলেও মনে করেন তারা। বলেন, ‘মনে হয় ছাত্র নির্যাতনে তারা একধরনের আনন্দ অনুভব করেন। এটা অবশ্যই একটা মানসিক বিষয়।’
এর সমাধান বিষয়ে বলেন, ‘সমাধান হলো যারা সেখানে ছেলে-মেয়ে দেবে তারা যেন সচেতন হয়। অভিভাবক বলবে কোনোভাবেই যেন এ ধরনের অমানবিক নির্যাতন না চালানো হয়। সেই সঙ্গে নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৫
আপনার মতামত জানানঃ