বান্দরবানে বাংলাদেশ সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে বান্দরবানে ২০০ গৃহহীন পাহাড়ি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়ার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আগে যাদের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, এখন তাদের বাদ দিয়ে অর্থের বিনিময়ে অন্যদের ঘর দেয়া হচ্ছে। আবার গৃহহীনরা নয়, ঘর পাচ্ছে সচ্ছল অনেক পরিবার।
জানা যায়, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় জেলার ছয় উপজেলায় ২০০ গৃহহীন পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে। এজন্য প্রকল্পের শুরুতেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে দরিদ্র্য পাহাড়িদের একটি তালিকা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে প্রকল্পের তালিকাভুক্ত দরিদ্র্য পাহাড়িদের বাদ দিয়ে ঘর বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে তালিকা বহির্ভূতদের নামে।
অনেক ক্ষেত্রে ৫০-৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে দানপত্রে স্বাক্ষর করে একজনের নামে বরাদ্দ দেয়া ঘর অন্যজনকে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া তালিকাবহির্ভূত যাদের নামে ঘর বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে, তারা অধিকাংশই সচ্ছল। এতে প্রকল্পের সুফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এ প্রকল্পে তালিকাভুক্তদের ঘর অন্য কাউকে দেয়ার নিয়ম নেই বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
সূত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিশেষ নকশায় গৃহ নির্মাণের লক্ষ্যে এ প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে একটি চিঠি পাঠায় বান্দরবান জেলা প্রশাসন। গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পতে জেলার ২০০ পরিবারের গৃহ নির্মাণের অনুমোদন দেয়।
অনুমোদনের পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন টাস্কফোর্স কমিটি সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বারদের মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারের তালিকা তৈরি করেন। এর মধ্যে বান্দরবান সদরে ৮৯টি, রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায় ১১টি করে, লামায় ২৪টি ও আলীকদম উপজেলায় ৩৯টি পরিবার রয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে এসব গৃহ নির্মাণ চলছে।
সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শনকালে সংবাদকর্মীরা দেখতে পান, সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের ভাঙ্গামুড়াপাড়ার উবামংয়ের নামে বরাদ্দ দেয়া ঘরটি নির্মাণ হচ্ছে স্থানীয় ব্যবসায়ী উম্যামংয়ের ভিটায়। জানতে চাইলে উবামং বলেন, আমার নামের ঘরটি আমি চাই। কিন্তু প্রতিনিধিরা (চেয়ারম্যান ও মেম্বার) বলছেন, আমার জায়গা ছোট। তাই তারা আমার নামের ঘরটি উম্যামংকে দিয়ে দিচ্ছেন।
সচ্ছল হয়ে দরিদ্রদের জন্য দেয়া ঘর কেন নিচ্ছেন প্রশ্নের উত্তরে উম্যামং বলেন, আমরা লেখালেখি (দানপত্রে স্বাক্ষর) করে নিয়েছি। তবে কাগজটি চেয়ারম্যান সানুপ্রুর কাছে রয়েছে। এদিকে একই ওয়ার্ডের কুহালং হেডম্যানপাড়ায় একটি সাদা কাগজে ঘর দানসংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্রের মাধ্যমে কোয়াইসাংউ মারমার নামে বরাদ্দ হওয়া ঘরটি মংনুসে মারমাকে দেয়া হয়েছে। পাড়ার বৌদ্ধবিহারের পেছনে মংনুসের প্রায় এক কানি (৪০ শতাংশ) জমির মধ্যে নির্মাণ করা ঘরের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
স্থানীয়রা জানান, ভাঙ্গামুড়াপাড়ার উম্যামং ও কুহালং হেডম্যানপাড়ার মংনুসে মারমা স্থানীয়ভাবে সচ্ছল। চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের মেম্বারদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে একজনের নামে বরাদ্দ হওয়া ঘর অন্যজনকে দেয়ার অন্তরালে অবৈধ লেনদেন থাকতে পারে। ভুক্তভোগী দরিদ্ররা নিজে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। এজন্য দরিদ্রদের ঘর পাচ্ছে স্থানীয় সচ্ছলরা।
এসব বিষয়ে ৮ নং ওয়ার্ডের মেম্বার অংসাহ্লা মারমা বলেন, শুনেছি ৫০-৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে মংনুসেকে ঘর দান করেছেন বলে দেখানো হয়েছে। ঘর নির্মাণকাজ শুরুর আড়াই মাস আগে কোয়াইসাংউর ঘর মংনুসেকে দেয়ার কারণে আপত্তি জানাতে ইউএনওর কাছে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নিজের বদনাম হবে, শুনলে পার্বত্য মন্ত্রী নাখোশ হবেন প্রভৃতি কারণ দেখিয়ে ইউএনওর কাছে যেতে বাধা দিয়েছিলেন চেয়ারম্যান। পরে চেয়ারম্যানের কথামতো দানসংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্রে স্বাক্ষর করেছি। তিনিও এতে স্বাক্ষর করেছেন। তবে ভাঙ্গামুড়াপাড়ার উবামংয়ের নামের ঘর উম্যামং কীভাবে পেল, তা জানা নেই। এছাড়া ৮ নং ওয়ার্ডে বরাদ্দ হওয়া ১০টি ঘরের মধ্যে একটি ২ নং ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের মিনঝিরিপাড়ার মেপ্রুসাং মারমার নামে বরাদ্দ হওয়া ঘরের সন্ধান মেলেনি। মেপ্রুসাং পাড়ায় না থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে ওই ওয়ার্ডের মেম্বার অংসাহ্লা (৬ ও ৮ নং এ দুই ওয়ার্ডের দুই মেম্বারের নামই এক) জানান, চেয়ারম্যান ও ঠিকাদার মিলে কোথায় নির্মাণ করছে খোঁজ নিতে হবে। তবে আমার ওয়ার্ডের বাইরে নির্মাণ করা হলে যথাযথ দপ্তরে অভিযোগ করব।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে কুহালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সানুপ্রুর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। তাই তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ইউনিয়নের সচিব সাইফ উদ্দিন জানান, চেয়ারম্যান কয়েক দিন ধরে অসুস্থ। তিনি চিকিৎসাধীন। একইভাবে জানা যায়, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও অসুস্থ এবং তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন। তবে সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাসনিম জাহান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. মাহবুব হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বান্দরবান জেলায় ২০০টি পরিবারে গৃহ নির্মাণের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রকৃত দরিদ্র পরিবারে গৃহ নির্মাণ করে দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। এর বাইরে কারো ঘর পাওয়ার নিয়ম নেই।
এসডাব্লিউ/বিবি/আরা/২০৪০
আপনার মতামত জানানঃ