কুমিল্লার বরুড়ায় শিক্ষকের বেত্রাঘাতে সিহাব (১২) নামের এক মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শুক্রবার (৫ আগস্ট) উপজেলার ঝলম ইউনিয়নের শশইয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
সিহাব শশইয়া গ্রামের শুকুর আলী ডিলারের ছেলে। সে স্থানীয় মেড্ডা আল মাতিনিয়া নুরানি মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিল।
অভিযুক্ত আব্দুর রব ঝলম ইউনিয়নের মেড্ডা আল মাতিনিয়া নুরানি মাদরাসার শিক্ষক। মারা যাওয়া সিহাব ওই শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে নুরানি শিক্ষা গ্রহণ করছিল।অভিযুক্ত শিক্ষক আবদুর রবকে (২৭) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডেকে এনেছে পুলিশ।
পরিবার ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, সিহাব ওই মাদ্রাসায় শিক্ষক আবদুর রবের অধীনে নুরানি বিভাগে পড়ত। পড়া না পারায় সাত থেকে আট দিন আগে তাকে বেদম বেত্রাঘাত করেন আবদুর রব। এতে সিহাব অসুস্থ হয়ে পড়ে।
খবর পেয়ে তার বাবা আবদুস শুক্কুর ছেলেকে মাদ্রাসা থেকে বাড়িতে নিয়ে যান এবং স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করান। অবস্থার অবনতি হলে গতকাল দুপুরে সিহাবকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য রওনা দেন পরিবারের সদস্যরা। পথে তার মৃত্যু হয়।
নিহত সিহাবের ভাবি সাবিকুন নাহার ঝুমুর অভিযোগ করে বলেন, আমার দেবর সিহাবকে কয়েক দিন আগে মেড্ডা মাদ্রাসার শিক্ষক আব্দুর রব বেত্রাঘাত করেন। এ সময় সিহাব অসুস্থ হয়ে পড়লে শিক্ষকরা তাকে ওষুধ এনে খাওয়ান। তাতেও সে সুস্থ না হওয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) মাদ্রাসা থেকে ফোন করে সিহাবের অসুস্থতার খবর জানানো হয়। পরে আমার শ্বশুর মাদ্রাসায় গিয়ে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। সিহাবের অবস্থা খারাপ হওয়ায় শুক্রবার সকালে তাকে বরুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সেখানে নেওয়ার কিছুক্ষণ পর দুপুর ১টা ১২ মিনিটের সময় সিহাবের মৃত্যু হয়।
তিনি আরও বলেন, সিহাব প্রথমে বিষয়টি পরিবারকে জানায়নি। সে বলেছে এমনিতেই তার শরীরে জ্বর এসেছে। পরে আজ বরুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে যখন কুমিল্লায় রেফার করা হয়, তখন তার কাছে অসুস্থতার কারণ জোর দিয়ে জানতে চাইলে সে ওই হুজুরের নাম না বলে, বলে হুজুর আমাকে মেরেছে। আমি যদি কাউকে এটা বলি, তাহলে মাদ্রাসায় ফিরলে আবার আমাকে মারবেন। তাই সে ওই শিক্ষকের নাম বলেনি।
জোর দিয়ে জানতে চাইলে সে ওই হুজুরের নাম না বলে, বলে হুজুর আমাকে মেরেছে। আমি যদি কাউকে এটা বলি, তাহলে মাদ্রাসায় ফিরলে আবার আমাকে মারবেন। তাই সে ওই শিক্ষকের নাম বলেনি।
বরুড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকবাল বাহার বলেন, দুপুরে মেড্ডা আল মাতিনিয়া নূরানী মাদ্রাসার ছাত্র সিহাবের মৃত্যুর খবর পাই। অভিযোগ ছিল শিক্ষক আব্দুর রবের বেত্রাঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। এ অভিযোগের ভিত্তিতে সন্ধ্যায় তাকে আটক করে থানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের আইনে ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ৷ ২০১১ সালে হাইকোর্টের এক আদেশের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে৷ আর তাতে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির সংজ্ঞাও দেয়া হয়েছে৷ শারীরিক শাস্তি বলতে যেকোনো ধরনের দৈহিক আঘাত বলা হয়েছে৷ মারধর ছাড়াও আইনে কান ধরা, চুল টানা, বেঞ্চের নিচে মাথা রাখতে বাধ্য করাও দৈহিক শাস্তি৷ আর মানসিক শাস্তির মধ্যে শিশু বা তার পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বাজে মন্তব্য বা যেকেনো আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি৷
এতে বলা হয়, হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, শিক্ষার্থীর দিকে চক বা ডাস্টারজাতীয় বস্তু ছুড়ে মারা, আছাড় দেয়া ও চিমটি কাটা, কামড় দেয়া, চুল টানা বা চুল কেটে দেওয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল চাপা দিয়ে মোচড় দেয়া, ঘাড় ধাক্কা, কান টানা বা উঠবস করানো, চেয়ার, টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, রোদে দাঁড় করিয়ে বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে এমন কোনো কাজ করানো, যা শ্রম আইনে নিষিদ্ধ৷
এই পরিপত্রে শাস্তির কথাও বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ শিশুদের শারীরিক শাস্তি দিলে ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি হবে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷
শিক্ষা মন্ত্রণালয় শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের শাস্তি দেয়াকেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেছে৷ যাদের বিরুদ্ধে এই অপরাধ প্রমাণ হবে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ একই সঙ্গে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে৷
কিন্তু এরপরও বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়ার প্রবণতা বেশ লক্ষ্য করা যায়৷ বিশেষ করে মাদ্রাসায় এটা প্রকট৷
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষকদের সেভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। এ কারণে তারা শিশুদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সেটা জানে না। আর মাদ্রাসায় যেসব অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠায় তারাও সচেতন না। এ কারণে নির্যাতন হলেও তারা তেমন কিছু বলে না। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে ছাত্র নির্যাতনের একটি পরিবেশ অনেক দিন থেকেই চলে আসছে।’
এভাবে পেটানোর পেছনে শিক্ষকদের মানসিকতাই দায়ী বলেও মনে করেন তারা। বলেন, ‘মনে হয় ছাত্র নির্যাতনে তারা একধরনের আনন্দ অনুভব করেন। এটা অবশ্যই একটা মানসিক বিষয়।’
এর সমাধান বিষয়ে বলেন, ‘সমাধান হলো যারা সেখানে ছেলে-মেয়ে দেবে তারা যেন সচেতন হয়। অভিভাবক বলবে কোনোভাবেই যেন এ ধরনের অমানবিক নির্যাতন না চালানো হয়। সেই সঙ্গে নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন।’
তারা বলেন, ‘এখানে শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার দর্শন অনুযায়ী গড়ে ওঠেনি৷ নানা ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত৷ কেউ কেউ মনেই করেন কিছুটা মারপিট সুশিক্ষার জন্য দরকার আছে৷ আর কওমী মাদ্রাসাগুলো যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই তাই তারা সরকারের নির্দেশও মানতে চায় না’৷
আরও বলেন, ওস্তাদের মার খেলে ওই জায়গাটা বেহেশতে যায়— এটা যদি হয় চিন্তা তাহলে মারপিট থামবে কীভাবে? সামাজিক এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই শিশুদের বলাৎকার করেও কেউ কেউ রেহাই পেয়ে যান৷
অবশ্য শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা দিতে হলে, তাদের সঠিক মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হলে সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ করতে হবে৷ সেটা যেমন স্কুলে তেমনি তার ঘরে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ