চলমান ডলার সংকট কাটাতে ৪.৫ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট সাপোর্ট) চেয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। গত রোববার আইএমএফ-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ক্রিস্টালিনা জর্জিভার কাছে লেখা প্রস্তাবটি সংস্থাটির রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ অফিসের মাধ্যমে ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়েছে। দেশে আইএমএফ-এর সাম্প্রতিক সফরের পরই এই প্রস্তাব পাঠানো হয়।
অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে আইএমএফ-কে প্রয়োজনীয় আলোচনা শুরুর অনুরোধ করা হয়। বাংলাদেশ যাতে আগামী তিন বছরের জন্য অর্থপ্রদানের ভারসাম্য রক্ষা এবং বাজেটের প্রয়োজনে এই ঋণ ব্যবহার করতে পারে- সে বিষয়ে আলোচনা শুরুর অনুরোধ জানানো হয়েছে। গত রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে আইএমএফ’র কাছে ঋণ চেয়ে বাংলাদেশের সরকার চিঠি পাঠিয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।
আইএমএফ’র এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘ক্রেডিটরস রেজিলিয়্যান্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ট্রাস্ট’ থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য আলোচনার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ৪১৬ কোটি ডলার সহায়তার অনুরোধ জানিয়েছে।
মূলত লেনদেনের ভারসাম্য ঘাটতি মেটাতে এবং বাজেটসহায়তা হিসেবে ঋণ চেয়েছে। আর বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, এর মধ্যে রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ট্রাস্ট (আরটিএস) কর্মসূচির আওতায় ১ বিলিয়ন ডলার বা ১০০ কোটি ডলারও রয়েছে।
বাংলাদেশ ছাড়াও আইএমএফের ঋণ পেতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বিপদে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। বাংলাদেশর অর্থনীতি মোটেই শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তাদের মতো মহাবিপদেও বাংলাদেশ নেই। দেউলিয়া হয়েছে শ্রীলঙ্কা, আর পাকিস্তানও তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে আছে। তারপরও বাংলাদেশকে কেন আইএমএফের ঋণ নিতে হচ্ছে—সে প্রশ্ন অনেকেরই।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাস, যন্ত্র ও পণ্যের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে। সেই চাপ সামলাতেই আইএমএফ দাতা সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ।
মূল্যস্ফীতি সারা বিশ্বেরই এখন এক নম্বর সমস্যা। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক (-) ১৫.১২ শতাংশ।
সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের বাণিজ্যঘাটতি এখন ৩ হাজার ৮৬ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাণিজ্যঘাটতি। আমদানি ব্যয় ও প্রবাসী আয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির কারণে চলতি হিসাবের ঘাটতি এখন ১ হাজার ৭২৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এটিও বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আর সব মিলিয়ে সামগ্রিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৩৭১ কোটি ডলার। অথচ আগের অর্থবছরেও ছিল ৭৫০ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত। অর্থনীতির এই চিত্র আইএমএফকে দেওয়া চিঠিতেও উল্লেখ করা হয়েছে।
মূলত সরকারের সব ধরনের আয় কমে গেছে। জ্বালানি সংগ্রহে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানির সংকটে আছে দেশ। কমাতে হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। বহু বছর পরে লোডশেডিংয়ের অভিজ্ঞতা নিতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। এর বাইরে দৃশ্যমান আরেকটি বড় সংকট হচ্ছে ডলারের দাম। বিশ্ববাজারেই ডলার প্রতিদিন শক্তিশালী হচ্ছে। দেশের মধ্যে সরকারকেও এখন টাকার অবমূল্যায়ন করতে হচ্ছে।
সব মিলিয়ে চাপ পড়ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভে। দেশে বর্তমানে মজুত আছে ৩ হাজার ৯৬৭ কোটি ৪২ লাখ ডলার। অথচ এক বছর আগেই তা ছিল ৪ হাজার ৬৩৯ কোটি ১৪ লাখ ডলার।
সাধারণত বলা হয়ে থাকে, তিন মাসের সমান বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থাকাটা অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক। বাংলাদেশে রিজার্ভ কমলেও এখনো তা দিয়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।
জুলাই ২০২১ থেকে মে ২০২২ পর্যন্ত বাংলাদেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি তৈরি হয়েছে ১৭ দশমিক ২ বিলিয়ন, যা আগের বছরের ওই সময়ে ছিল মাত্র ২.৭৮ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের কাছে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশের সরকার বলেছেন, আগের বছরের তুলনায় এই সময়ে আমদানি বেড়েছে ৩৯ শতাংশ।
আমাদের এখন ঋণদাতা না বলাই ভালো। আমরা একটু সহায়তা করেছি। শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিয়ে আমরা ঋণ খুয়েছি।
রবিবার আইএমএফের কাছে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে চিঠি পাঠানো হলেও বুধবার সাংবাদিকদের অনুসন্ধানের পর মুখ খুলতে শুরু করেন সরকারি কর্মকর্তারা।
দৈনিক প্রথম আলোকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন ”অর্থের দরকার পড়লে কে দেবে? আমরা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে থাকি। দেশে গুরুত্বপূর্ণ যেসব প্রকল্প চলমান, সেগুলো শেষ করতে অর্থের দরকার।”
তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) – সবার কাছ থেকেই স্বল্প সুদে ঋণ নেয়া হয়। ঋণগুলো নেয়া হয় সাধারণত দীর্ঘ মেয়াদে”।
‘আরও বলেন, “এবার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, হচ্ছে এবং আরও হবে। লেনদেনের ভারসাম্য ও বাজেট সহায়তা বাবদ ঋণ পেতে একটা আনুষ্ঠানিক আলোচনা যাতে শুরু করে, সেজন্য আইএমএফকে অনুরোধ করা হয়। আশা করছি, আইএমএফ এ ব্যাপারে একটা মিশন নিয়ে আসবে,”
তবে পুরো ঋণ প্রক্রিয়াটি সময় সাপেক্ষ বলে তিনি জানিয়েছেন। কবে নাগাদ এই ঋণ পাওয়া যাবে এবং কত টাকা কী শর্তে পাওয়া যাবে- সেসব পরবর্তীতে পরিষ্কার হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
১৯৯০ সালে আইএমএফ থেকে প্রথম ঋণ নেয় বাংলাদেশ। তখন সামান্য পরিমাণে ঋণ নেয়া হয়েছিল। এরপর ২০০৩ সালে দারিদ্র্যবিমোচন ও প্রবৃদ্ধি সুবিধার (প্রভার্টি রিডাকশন অ্যান্ড গ্রোথ ফ্যাসিলিটি) আওতায় বাংলাদেশ ৩০ কোটি ডলার ঋণ নেয়। ২০১১ সালে টাকার মান দ্রুত অবনতি হলে সরকার এপটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটির আওতায় ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষায় ব্যবহার করে। সর্বশেষ করোনার সময়ে র্যাপিড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি অ্যান্ড পারচেজ অব র্যাপিড ফাইনান্সিং ইনস্ট্রুমেন্ট আওতায় ৭৩ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে সরকার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ২০২১ সালের জুন শেষে বাংলাদেশের কাছে আইএমএফ’র ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮৮ কোটি ৯৮ লাখ এসডিআর বা প্রায় ১২০ কোটি ডলার। এ ছাড়া করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই সরকার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে বাজেট ও টিকা সহায়তা হিসেবে ঋণ নিচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত সরকার বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, জাইকা, ওপেক ফান্ড, কোরিয়ান ঋণদাতা সংস্থা ইডিসিএফ, ইইউ, জার্মানির সংস্থা কেএফডাব্লিউ, এএফডি থেকে ৭ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা নিয়েছে। এরমধ্যে ৫ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে বিভিন্ন সংস্থা। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাকি ১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ছাড় হবে বলে আশা করছে সরকার।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ”আমরা দেখতে পেয়েছি, সাম্প্রতিক সময়ে ফরেন এক্সচেঞ্জের একটি বড় ধরনের সরবরাহ ঘাটতি আছে বাংলাদেশে এবং ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ওপর যথেষ্ট প্রেশার আছে। সেই চাপ একটু কমানোর জন্য সরকার এখন আইএমএফর কাছে গেছে।”
তারা বলছেন, ”গত এক দশক ধরে ফরেন এক্সচেঞ্জ নিয়ে এই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়নি বাংলাদেশ। কারণ এই সময়ে রেমিটেন্স এবং রপ্তানি – দুটোই কম বেশি ভালো করেছে। কিন্তু এখন বিশ্বে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার কারণে রেমিটেন্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রপ্তানি ভালো হলেও আমদানি যে হারে বেড়েছে তাতে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে একটা চাপ তৈরি করেছে।”
তারা আরও বলেন, ”সরকার বুঝতে পারছে যে, অন্য সোর্স থেকে ডলার সরবরাহ বাড়িয়ে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয় এই মুহূর্তে। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই বলা যেতে পারে, বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে গেছে।
আমাদের এখন ঋণদাতা না বলাই ভালো। আমরা একটু সহায়তা করেছি। শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিয়ে আমরা ঋণ খুয়েছি।”
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ