নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা। দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে ঠিক কী হয়, তা এই দেশটিকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, খাবার নেই, জ্বালানি নেই— চারিদিকে কেবল হাহাকার।
তীব্র এই সংকট এবং এর জেরে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা গোটা বিশ্বের সামনে শ্রীলঙ্কাকে একটা উদাহরণ হিসাবে সামনে নিয়ে এসেছে।
ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কা এশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের জন্য সর্তক বার্তা বলে উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান।
বিশ্ব সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিসটালিনা জর্জিবা শনিবার জানিয়েছেন, অতিমাত্রায় ঋণের বোঝা, সীমিত সম্পদ ও নীতিমালা থাকার কারণে বেশ কিছু দেশ ভয়াবহ সমস্যার পড়ে যেতে পারে। বেশি দূর নয়, সতর্কতামূলক শ্রীলঙ্কার দিকে নজর দিলেই হবে।
আইএমএফ প্রধানের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলো ব্যাপক মাত্রায় অর্থ পাচার ও অতি মুনাফার আশায় উন্নত দেশে মূলধন বিনিয়োগের মতো সংকটে জর্জরিত হতে পারে। এতে করে সংকট মোকাবিলায় এসব দেশের সরকারের নেয়া নীতিমালা বড় ধরনের হোচট খেতে পারে।
উন্নয়নশীল দেশগুলো ব্যাপক মাত্রায় অর্থ পাচার ও অতি মুনাফার আশায় উন্নত দেশে মূলধন বিনিয়োগের মতো সংকটে জর্জরিত হতে পারে। এতে করে সংকট মোকাবিলায় এসব দেশের সরকারের নেয়া নীতিমালা বড় ধরনের হোচট খেতে পারে।
খাবার, জ্বালানি ও ওষুধের মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির দাম পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে দুই কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার দেশ শ্রীলঙ্কা।
দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি ছাড়িয়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। সেই সঙ্গে পণ্যমূল্য এক বছরে বেড়েছে ৮০ শতাংশ। চলতি বছর আন্তর্জাতিক বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারসহ বিভিন্ন মুদ্রার বিপরীতে দ্বীপরাষ্ট্রটির মুদ্রা রুপির ব্যাপক দরপতন হয়েছে।
গত কয়েক বছরে বিপুল পরিমাণ ঋণের চাপে পড়ে গেছে শ্রীলঙ্কা। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে গত দুই দশকে শ্রীলঙ্কা প্রথমবারের মতো বৈদেশিক ঋণের বোঝায় দেউলিয়া ও খেলাপি রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
এমন অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য দেশটির সরকার আইএমএফের কাছ থেকে জরুরি সহায়তা হিসেবে ৩ বিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের ডলার পরিমাণ বেল আউট চেয়েছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অচলাবস্থার কারণে তা আটকে গেছে।
সেই সঙ্গে বিশ্ববাজারে এমন অস্থিরতার মধ্যে লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি ও ঊর্ধ্বমুখী সুদের হার, মুদ্রার দরপতন, উচ্চমাত্রায় ঋণের বোঝা ও রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে এশিয়াসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশ ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা জানিয়েছে আইএমএফ।
চীন এ অঞ্চলে বিভিন্ন দেশকে বড় অঙ্কের ঋণ সহায়তা দিয়েছে। সেই সঙ্গে বলা চলে, এসব দেশের অর্থব্যবস্থাপনা ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণে পরোক্ষ প্রভাব ও ভূমিকাও রয়েছে বেইজিংয়ের।
তবে চীনের ঋণ সহায়তা দেয়ার শর্ত এখনও স্পষ্ট নয় এবং তারা কীভাবে খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনা করে তাও স্পষ্ট করে না। এ অবস্থায় পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ও লাওসসহ আরও কয়েকটি দেশে শ্রীলঙ্কার পরিণতি আসতে পারে বলে আশঙ্কা জানিয়েছে আইএমএফ।
এদিকে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি মে মাসে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ, যা গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
রিজার্ভের পরিমাণ কমতে থাকায় এরই মধ্যে সরকার অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি বন্ধ করার নীতি অনুমোদন দিয়েছে। প্রবাসীদের আয় (রেমিট্যান্স) দেশে পাঠানোকে উৎসাহিত করতে এ-সংক্রান্ত নীতিমালা আরও সহজ করেছে সরকার। সেই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ কমিয়ে আনা হয়েছে।
অর্থনীতি বিশ্লেষক কিম ইং তান বিবিসিকে জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক সংকটে থাকা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সরকার নিত্যপণ্য ও স্বাস্থ্যসেবায় ভর্তুকি চালিয়ে যেতে চরম হিমশিম খাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারকে ব্যয়ের তালিকা গুরুত্বের ভিত্তিতে আবারও সাজাতে হবে। এবং ভোক্তার আচরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে কঠোর নীতিমালাও আরোপ করেছে সরকার।’
খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির ঊর্ধ্বমুখী দাম মহামারিতে বিপর্যস্ত বিশ্বের অর্থনীতিতে ফের চাপ সৃষ্টি করেছে।
বিশ্ববাজারে নানা ঘাত-প্রতিঘাত সামাল দিতে উন্নয়নশীল দেশগুলো ব্যাপকহারে বিশ্বসংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেয়া অব্যাহত রেখেছে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, অনেক রাষ্ট্র এখনো তাদের দেউলিয়া হওয়ার পরিস্থিতি এড়াতে পারে, যদি বিশ্ববাজার স্থিতিশীল হয় এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যদি তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। ইতিমধ্যে উন্নয়নশীল অনেক দেশ আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছে। কিন্তু দেশগুলোর আর্থিক সংকট এখন চরমে পৌঁছে যাচ্ছে। সংকটের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে আর্জেন্টিনা, পাকিস্তান, ইউক্রেন, বেলারুশ, তিউনিশিয়া, ঘানা, মিশর, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, ইকুয়েডর এবং এল সালভাদর।
শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমেছে তলানিতে। ফলে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির সক্ষমতা হারাচ্ছে দেশটি। চলছে জরুরি অবস্থা। এসব কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কার এ পরিণতির জন্য যেসব বিষয় দায়ী, সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিয়ে এখান থেকে বাংলাদেশকে শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলেন, তাদের যে ভুলগুলো ছিল তা থেকে শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশকেই শিক্ষা নেওয়া উচিত। এক দিনেই তো শ্রীলঙ্কা এ অবস্থায় পড়েনি। তাই আমাদেরও সতর্ক থাকতে হবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ