জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করে বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের প্রত্যাশার কথা ইসির কাছে তুলে ধরেছেন দেশের উন্নয়ন সহযোগী ১৪ দেশের কুটনীতিক। রোববার বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপিয় ইউনিয়নের হাইকমিশনের নেতৃত্বে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টভুক্ত (ওইসিডি) ১৪টি দেশের রাষ্ট্রদূত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আওয়ালসহ ইসি সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। বৈঠক শেষে প্রতিনিধি দলের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথাল চুয়ারড।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় কোনো রকম নির্বাচনই আর অহিংস ও দুর্নীতিমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারছে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনগুলো অবিতর্কিত ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনগুলোতে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল। তবে সেনাসমর্থিত এবং অসাংবিধানিক ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীন সরকার আমলে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
বাহ্যিকভাবে ওই নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাস-সহিংসতা দৃশ্যমান না হলেও নির্বাচনটিতে গৃহীত ভোটের পরিসংখ্যানই ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির সাক্ষ্য দেয়। কারণ, স্বাভাবিক সময়ে কেবল স্থানীয় সরকার নির্বাচন (ইউপি, উপজেলা, সিটি করপোরেশন) প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে ৬৮, ৭০, ৭৫ শতাংশ বা এর কম-বেশি ভোট পড়তে দেখা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চেয়ে কম। অথচ নবম সংসদ নির্বাচনে অফিসিয়াল কাস্টিং রেট হচ্ছে ৮৬.৩৪ শতাংশ, যা অন্যায়ভাবে ‘না’ এবং ‘বাতিল’ ভোট বাদ দিয়ে হিসাব করে দেখানো হয়েছে। ওই দুরকম ভোটসহ কাস্টিং রেট ৮৭.৬০ শতাংশ, যার মধ্যে পাঁচটি আসনে ৯৫ শতাংশ বা তার বেশি, ১৯টি আসনে ৯৪ শতাংশ বা তার বেশি এবং ৯৪টি আসনে ৯০ শতাংশ বা তার বেশি ভোট কাস্ট হয় (বাংলাদেশি নির্বাচন, খুলনা : অধ্যয়ন পরিষদ, ২০২১, পৃষ্ঠা-১৪২)। এ থেকে অনুধাবন করা যায়, ওই নির্বাচন কতটা স্বচ্ছ হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করে এককভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা চালু করার পর সংসদ নির্বাচন আর স্বচ্ছ হয়নি। এমন নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদলীয় প্রার্থীদের জয়ী হতে অসুবিধা হয়নি। দলীয় ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে দুটি নতুন কলঙ্কের পাতা যোগ করে। দশম নির্বাচনে জনগণ প্রত্যক্ষ করেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ক্ষমতাসীন দলের ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন সুনিশ্চিত করেন। আর একাদশ সংসদ নির্বাচনে তো নির্বাচনের আগের রাতে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা পোশাকধারী বাহিনী ও প্রিসাইডিং অফিসারদের আয়ত্তে নিয়ে ভোটের কাজ এগিয়ে রাখেন। ফলে পরপর এমন দুটি নির্বাচন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করে।
তাই এবারের নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমন গুরুত্বপূর্ণ গোটা বাংলাদেশের জন্য। এ বিষয়ে আজ বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের বিষয়ে নাথাল চুয়ারড বলেন, নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত, দেশের গণতন্ত্র আরও কার্যকর ও শক্তিশালী, অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিতে সহায়ক অবস্থা তৈরি এবং সকল অংশীজনের যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আমরা নির্বাচন কমিশনকে যেকোনো প্রকার সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। গণতান্ত্রিক ধারাকে আরও শাণিত করার মধ্য দিয়ে নাগরিকদের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে সহায়তা করতে চায় ওইসিডি সদস্য দেশগুলো।
বৈঠকের বিষয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আওয়াল বলেন, ‘উনারা এসেছেন, এটা একটা ট্রাডিশন। আগেও এসেছেন তারই ধারাবাহিকতা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আইন-কানুন, আমাদের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আমরা আমাদের কার্যক্রমগুলো জানিয়েছি। উনার সাধারণত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর জোর দিয়ে থাকেন। সেজন্যই উনারা ইলেকশনটা যদি ইনক্লুসিভ, একসেপ্টবল, ফ্রি এবং ফেয়ার হয়, তাহলে উনারাও খুশি হবেন, পুরো দেশবাসী খুশি হবেন এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আমরা আমাদের দিক থেকে ইলেকশন কমিশন হিসেবে আমাদের যা যা করণীয় আমরা করবো। উনারা প্লিজড। বলেছি ভবিষ্যতেও যখন প্রয়োজন হয়, আসবেন।’
রোববার বেলা তিনটায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল, নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আহসান হাবিব, রাশিদা সুলতানা ও মো. আলমগীর। বিশ্বের ৩৮টি দেশ ওইএসডি’র সদস্য হলেও আজ ১৫টি দেশের প্রতিনিধিদের আসার কথা ছিল। তবে অষ্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার জেরেমি ব্রুর আসেননি। যার ফলে বৈঠকে ১৪টি দেশের প্রতিনিধি ছিলেন।
যেসব রাষ্ট্রদূত আজ বৈঠকে ছিলেন তারা হলেন- ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি. হাস, কানাডার হাইকমিশনার লিলিও নিকোলস, ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত উইনি ইস্ট্রুপ পিটারসেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি, ফ্রান্সের সহকারী রাষ্ট্রদূত গুইলাম অড্রেন ডি কেরড্রেল, জার্মানির রাষ্ট্রদূত আছিম ট্রস্টার, ইতালির রাষ্ট্রদূত এনরিকোনুনজিয়াটা, নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত এনি গিয়ার্ড ভ্যান লিউয়েন, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এসপেন, স্পেনের রাষ্ট্রদূত ফ্রান্সিসকো ডি আসিস বেনিটেজ সালাস, সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ড, তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তোরান ও জাপানের হেড অব মিশন ইয়ামায়া হিরোয়ুকি।
বৈঠকে সহযোগিতার বিষয়ে প্রতিনিধিরা কিছু বলেছেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন- ওনারা যেটা বলেছেন সহযোগিতা করার কথা। আমরা চট করেই নিজেরা কিছু বলিনি। আমরা বলেছি আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দেখবো। কোনো টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে আমরা তাদের জানাবো।
কী ধরনের সযোগিতা করবে, এই প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন- আমরা বলেছি সেটা আমরা বিবেচনা করে দেখবো। আমরা এখনো সহযোগিতা চাইনি।
সক্ষমতা বাড়ানোর সহযোগিতা নাকি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহযোগিতা করবে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা ইলেকশন রিলেটেড। সেটা হতে পারে ভোটার এজুকেশন, ইসির সক্ষমতা বৃদ্ধি বিষয় হতে পারে। আমি তো বলেছি আমরা ওনাদের জানাইনি এখনও। আমরা যদি মনে করি কোনো রকম সহযোগিতা বা টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স বা ট্রেনিং প্রয়োজন হবে, তখন তাদের জানাবো। এজন্য নিশ্চিত করে বলতে পারছি না কী ধরনের সহযোগিতা ওনারা দেবেন বা আমরা কী ধরনের সহযোগিতা চাইবো। তারা পর্যবেক্ষকের কথা বলেছেন-আমরা বলেছি আমাদের দিক থেকে কোনো বাধা নেই। তবে এ বিষয়ে ডিপ্লোম্যাটিকলি আলোচনা করে দেখতে পারেন। ফরেন অবজারভারদের বিষয়ে আপনারা ফরেন মিনিস্ট্রিতে একটু কথা বলে দেখতে পারেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্বের বিষয়ে কোনো কথা বলেছেন কিনা, এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ওনারা তেমন কিছু বলেননি। তারাও খুব ভালো করেই জানেন এখনও কিছু কিছু দল ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। ওনারাও বিশ্বাস করেন, আমরাও চেষ্টা করে যাব, যেন ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/২০০৫
আপনার মতামত জানানঃ