অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার কুমিল্লার নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কিছু হয়েছিল কি না, এমনটাই প্রশ্ন তুলেছেন অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার জেরেমি ব্রুয়ার। প্রসঙ্গত, আজ রোববার সিইসির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন জেরেমি। এ সময় আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
কুসিক নির্বাচনে কোন দলের প্রার্থী বিজয়ী হলেন তা নিয়ে তেমন আগ্রহের কারণ নেই। নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, প্রশ্নবিদ্ধ না হয় তাহলে তাতেই আমাদের স্বস্তি ও সন্তুষ্টি। সেই সুষ্ঠু নির্বাচনে যে পদে যে দলের প্রার্থীই বিজয়ী হোন আমাদের বলার কিছু নেই। কিন্তু এখন আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা যেখানে গেছে সেটি বলতে গেলে একটি দুঃস্বপ্নের মতো।
কুসিক নির্বাচনের পরদিন কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ও তাতে পরিবেশিত খবর খুব সতর্কতার সাথে পড়ার চেষ্টা করা যাক। ১৬ জুন দৈনিক সমকালে একটি খবরের শিরোনাম ছিল- ‘সিইসি উৎফুল্ল নন, বেদনার্তও নন’। কুসিক নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি এই মন্তব্য করেন। এই মন্তব্যের ব্যাখ্যা করলে এমনটি দাঁড়ায়- নির্বাচনী তরী তীরে এসে না ডুবলেও, হঠাৎ সৃষ্ট ঝড়ো হাওয়ায় তরী টালমাটাল হয়েছিল।
যেমন- নির্বাচনকালে বহিরাগতরা বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের বাইরে সমবেত হয়ে সাধারণ ভোটারদের ভোটদানে অসুবিধার সৃষ্টি করেছিল। এতে ভোটারদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ভোটের ফল ঘোষণার এক পর্যায়ে তুমুল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি সেখানে লক্ষ করা যায়নি। কী কারণে তারা ছিল না তা জানা যায়নি। এসব ১০ মণ দুধের মধ্যে এক ফোঁটা গো-মূত্রের মতোই। এ ছাড়া ইভিএম নিয়েও ছিল বড় বিপত্তি।
ইভিএম ক্ষমতাসীন দলের মনোবাঞ্ছা আমরা জানি। ইভিএম ব্যবহারে নানা কারণে তাদের আগ্রহের কোনো শেষ নেই। ক্ষমতাসীন দল অবশ্য নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। কিন্তু সে সাথে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের ইভিএম নিয়ে মতামত জানা ইসির জন্য অতিআবশ্যিক। ইভিএম নিয়ে তাদের মতামত জানার ব্যাপারে ইসির চেষ্টা-আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, এ প্রশ্নে ইসি যেন ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। জাতীয় প্রতিষ্ঠানটির এমন ভূমিকা কেউই সমর্থন করবে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম একটি জাতীয় দৈনিকে তার একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘…নির্বাচনে পরাজিত প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু অভিযোগ করেছেন যে, তাকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, কিভাবে প্রমাণ করা যাবে যে তাকে পরিকল্পিতভাবে হারিয়ে দেয়া হয়নি। কারণ ইভিএমে যে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে কোনো পেপার ডকুমেন্ট নেই যে, ভোট পুনর্গণনা করা যাবে এবং বলা যাবে যে, এতে অসঙ্গতি নেই। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন আমাদের যে তথ্য দেবে সেটাই মেনে নিতে হবে। অথচ এর ওপর নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু।
ইভিএমের দু’টি দুর্বলতা সামনে এসেছে। একটি হলো- এই প্রক্রিয়া ভোটারদের ভোট দানে বিরত রাখছে ও অন্যটি এর কোনো পেপার ডকুমেন্ট থাকে না বলে এর ভোট গণনা প্রশ্নবিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে মরহুম প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরীর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। যখন এই যন্ত্র কেনা হয়, তখন নির্বাচন কমিশনের কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। ওই সময় ইভিএম কেনার সুপারিশপত্রে তিনি স্বাক্ষর করেননি যন্ত্রটির এই দুর্বলতার জন্য। ভারতেও দেখা গেছে, উচ্চ আদালতের নির্দেশে ইভিএমে পেপার ডকুমেন্ট যুক্ত করা হয়েছে।
এখন নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা ও ইভিএমের দুর্বলতার বিষয়টি আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক। কারণ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মাত্র একজন সংসদ সদস্য প্রচারের সময় ছিলেন এবং আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। আর জাতীয় নির্বাচনে থাকবেন ৩০০ এমপি।
প্রশাসনের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা যারা অতীতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছেন বা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছেন তারাও থাকবেন। এ ছাড়া সব রাজনৈতিক দল ও কয়েক হাজার প্রার্থীও থাকবে। এতগুলো পক্ষ যখন নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে, তখন তাদের ব্যাপারে ইসি কী করতে পারবে? সুতরাং যে ইভিএম মানুষকে ভোট দিতে বিরত রাখে, তা ব্যবহার করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এর যে দুর্বলতা- পেপার ডকুমেন্ট না থাকা, সেটি দূর না করলে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।’
এছাড়া একমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া বড় দল বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে না পারা, এমপি বাহার ইস্যু ইত্যাদি মিলিয়ে ইসির সক্ষমতার প্রতি চ্যালেঞ্জ তো থেকেই যাচ্ছে। এসব বিবেচনায় নিলে আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কতটা আশাবাদী হওয়া যায় সেটিই বড় প্রশ্ন।
এমপি বাহার ইস্যুকে সিইসি অতীতের ইস্যু ও তা শেষ হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন। এমপি মহোদয় কি নির্বাচনী বিধিবিধান লঙ্ঘন করেননি? এখন তো মাত্র একটি ক্ষেত্রে এমন অনিয়ম। আগামী নির্বাচনের সময় যখন ৩০০ আসনে সিটিং এমপিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে লাগাতারভাবে বিধি লঙ্ঘন করতে থাকবেন, তখন ইসি কোথায় যাবে?
আমাদের সংবিধান মতে, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধানের ১২৩(৩)-এর বিধান হচ্ছে- সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে- ক. ‘মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে’।
সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন হলে এমপিদের কিভাবে অনিয়ম করা থেকে বিরত রাখবে, নির্বাচনী বিধিতে এ সম্পর্কে প্রতিবিধান রয়েছে, যেমন- সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা-২০১৬-এর ২২ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগীরা নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারবেন না। এমপিরাও এই বিশেষ সুবিধাভোগীদের আওতায় পড়েন।
আমাদের সংবিধান অনুসরণ না করা নিয়ে বহু কথা বলা হয়েছে। সেখানে এসব বিধির তোয়াক্কা করবে কারা। যেমন করেননি এমপি বাহার। প্রচারণায় বিরত থাকার জন্য ইসি তাকে এলাকা ছাড়তে বললেও তিনি তাতে একটুকু তোয়াক্কা করেননি। তাকে এলাকা ছাড়তে বলার বিরুদ্ধে সরকারের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি এর বিরোধিতা করেছেন। তারা এমপি বাহারের মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার প্রশ্নও তোলেন। কিন্তু অহরহ যে, এখানে সেখানে মানবাধিকার ধুলায় লুটোপুটি খায়, সেখানে কিন্তু কখনোই কারো দৃষ্টি নেই।
দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন নিয়ে এখানে আলোচনা করা যায়। সেই প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে- ‘তখন চিঠিতে ইসি যা বলেছিল, এখন বলছে ঠিক তার উল্টোটা।’ খবরে বলা হয়, ‘আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে এলাকা ছাড়তে চিঠি দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
কিন্তু আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ইসির চিঠি আমলে নেননি, এলাকা ছেড়ে যাননি। উল্টো ইসির এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এর জবাবে তখন দুই নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, একজন সম্মানিত লোককে টেনে-হেঁচড়ে নামানো কমিশনের কাজ নয়। আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, সংসদ সদস্য এলাকা না ছাড়লে কমিশনের তেমন কিছু করার নেই।…
ভোটের পাঁচ দিন পর বাহাউদ্দিনের বিষয়ে ভিন্ন সুরে কথা বলেন কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল কুমিল্লার ভোট নিয়ে গত ২০ জুন ঢাকায় নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের বলেছেন, তাকে (কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন) আমরা স্থান ত্যাগ করতে বলতে পারি না এবং বলিনি। কাজেই তিনি আইন ভঙ্গ করেননি। আমরাও ব্যর্থ হইনি। তবে সিইসি পরে এমন কথা বললেও ৮ জুন বাহাউদ্দিনকে দেয়া চিঠিতে ইসি বলেছে, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি স্থানীয়ভাবে তদন্ত করালে লিখিত অভিযোগের সতত্যা পাওয়া যায়, যা মোটেই কাম্য নয়। উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, যেহেতু আপনি (বাহাউদ্দিন) বিধিবহির্ভূতভাবে কৌশলে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ গ্রহণ করেছেন, তাই আপনাকে ২৫৪ (সংসদীয় এলাকা) কুমিল্লা-৬ নির্বাচনী এলাকা ত্যাগের নির্দেশনা দেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এমতাবস্থায়, অবিলম্বে আপনাকে উল্লিøখিত নির্বাচন এলাকা ত্যাগ করে আচরণবিধি প্রতিপালন বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করছি।’
এমন অবস্থান নেয়ার পর ইসি কোন চাপে পশ্চাদপসরণ করল তা আমরা জানি না। তবে এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে, বৃহত্তর পরিসরে নির্বাচনের সময় ইসি যে ব্যর্থ হবে তাতে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ