ইতালিতে আইনি অনুমোদন ক্রমে চিকিৎসকদের সহায়তায় আত্মহত্যা করলেন এক ব্যক্তি। বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) ফেদেরিকো কার্বনি নামে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ইউরোপের দেশটিতে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা এটাই প্রথম।
ইতালির আইন অনুযায়ী, কারও মৃত্যুতে সাহায্য করা অপরাধ। কিন্তু ২০১৯ সালে সাংবিধানিক আদালত জানিয়ে দেন, সামান্য কিছু ব্যতিক্রম হতে পারে। তবে তার জন্য কঠিন শর্ত পালন করা জরুরি।
জানা গেছে, বিশেষ মেশিনের সহায়তায় তার শরীরে মৃত্যুর জন্য ওষুধ দেওয়া হয়। তার অন্তিম শয্যায় তার বন্ধু ও স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।
ফ্রেডরিকো কার্বনির মৃত্যুর ঘোষণা করে লুকা কসিওনি অ্যাসোসিয়েশন। এ সংস্থাটি ইউথেনেশিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুর সমর্থনে প্রচার চালায়। কার্বনির বিষয়টি নিয়েও তারা দীর্ঘদিন ধরে প্রচার চালাচ্ছিল।
ফ্রেডরিকো কার্বনি ছিলেন অবিবাহিত ট্রাক চালক। প্রায় দশ বছর আগে দুর্ঘটনার পর তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন।
লুকা কসিওনি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, মৃত্যুর আগে কার্বনি বলেছেন, ‘এভাবে জীবন থেকে বিদায় নিতে আমার আক্ষেপ হচ্ছে। কিন্তু বাঁচার জন্য আমি সবরকম চেষ্টা করেছি। আর সম্ভব নয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে জীবনের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছি। আমি সমুদ্রে নৌকার মতো ভাসছি।’
কার্বনিকে সাহায্য করার জন্য ২৪ ঘণ্টাই লোকের প্রয়োজন হতো। নিজে নিজে কিছুই করতে পারতেন না তিনি। মৃত্যুর আগে তিনি বলেছিলেন, এখন আমি যেখানে খুশি উড়ে যেতে পারব।
২০১৯ সালে ইতালির উচ্চ আদালত কিছু ক্ষেত্রে স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি দেয়। কিন্তু রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও রক্ষণশীল দলগুলো এর বিরোধিতা করে। সংঘাত এড়াতে বেশ কিছু শর্ত আরোপ করে দেন আদালত। সেসব মেনেই কেবল চিকিৎসকরা স্বেচ্ছামৃত্যুতে সহায়তা করতে পারবেন।
‘এভাবে জীবন থেকে বিদায় নিতে আমার আক্ষেপ হচ্ছে। কিন্তু বাঁচার জন্য আমি সবরকম চেষ্টা করেছি। আর সম্ভব নয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে জীবনের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছি। আমি সমুদ্রে নৌকার মতো ভাসছি।’
আদালতের নির্দেশনা অনুসারে, যে সব রোগীর আর কখনো ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নেই, যারা জীবন ধারণের জন্য সবসময় অন্যের ওপর নির্ভরশীল এবং শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করছে এবং সর্বোপরি রোগীর এই চেতনা থাকতে হবে যে, তিনি নিজের মৃত্যুবরণের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারবেন। এসমস্ত বিষয়গুলো থাকলেই কেবল স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমোদন দেওয়া হবে।
গত নভেম্বরে ইতালির নীতি বিষয়ক একটি কমিটির কাছ থেকে স্বেচ্ছা আত্মহত্যার অনুমতি পান কার্বনি। এরপর নিজের জীবনের ইতি টানতে ড্রাগ ও মেশিনের জন্য পাঁচ হাজার ইউরো জোগাড় করেন। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার চিকিৎসকদের সহায়তায় তার জীবনপ্রদ্বীপ নিভে যায়। ইতালি ছাড়াও নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম ও স্পেনসহ বেশ কয়েকটি দেশে স্বেচ্ছা আত্মহত্যার অনুমতি রয়েছে।
অতি সম্প্রতি কলম্বিয়ার একটি আদালত চিকিৎসা সহায়তায় আত্মহত্যাকে (Medically Assisted Suicide) আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে । সেক্ষেত্রে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগী আত্মহত্যা করতে ইচ্ছুক হলে তিনি চিকিৎসা কর্মীদের সহায়তা পাবেন।
সেখানকার আইনজীবীদের মতে এই নিয়ম কার্যকর করার ক্ষেত্রে কলম্বিয়া এখন লাতিন আমেরিকার প্রথম দেশ হয়ে উঠেছে। তবে কলম্বিয়া ছাড়াও, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবার্গ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজ্যও চিকিৎসা সহায়তায় আত্মহত্যার অনুমতি দেয় ।
বিশেষ ক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ডে আত্মহত্যায় সহায়তা প্রদান করা আইনিভাবে বৈধ। সূত্রের খবর, গত বছর অন্তত ১,৩০০ মানুষ এই প্রক্রিয়ার সাহায্য নিয়েছেন। সংস্থার দাবি, এ বার আইনি বৈধতা পেল আত্মহত্যা করার যন্ত্র ‘সারকো’।
‘ডক্টর ডেথ’ হিসেবে খ্যাত চিকিৎসক ফিলিপ নিটশে বলছেন, ‘আগামী বছরের মধ্যে সারকো ব্যবহারের উপযোগী হয়ে যাবে সুইজারল্যান্ডে। এখনও পর্যন্ত এই প্রকল্পে বহু অর্থব্যয় হয়েছে। কিন্তু আমাদের আশা, আমরা প্রয়োগের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি’।
তবে যন্ত্র নিয়ে সমালোচনাও কম হচ্ছে না। অনেকে বলছেন যে, এই যন্ত্রটি আসলে গ্যাস চেম্বারকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকের মতে, এই যন্ত্রের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে আত্মহত্যাকে সব ক্ষেত্রে মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত দু’টি এমন সারকো যন্ত্র তৈরি হয়ে রয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ চাহিদার কথা মাথায় রেখে আরও একটি যন্ত্রের থ্রি-ডি প্রিন্টিং শুরু করেছে এক্সিট ইন্টারন্যাশনাল। আগামী বছর থেকে সুইজারল্যান্ডে এই পরিষেবা দেওয়া শুরু করাই লক্ষ্য সংস্থার। যদিও তাতে বিতর্কের ঢেউ থামছে না।
স্টাইলিশ সুইসাইড মেশিন তৈরি করে নিটশে সবাইকে চমক দিতে চাইলেও, অনেকেই এতে নাখোশ। চিকিৎসাবিদরা বলছেন, এটা নৈতিকতা বিবর্জিত এবং মানুষের জন্য অমঙ্গলজনক। তারা বলছেন আত্মহত্যাকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছেন নিটশে।
১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটরিতে ইনজেকশনে আত্মহত্যাকে বৈধ হওয়ার পর পৃথিবীর প্রথম চিকিৎসক হিসেবে নিটশে ৪ জনের আত্মহত্যার তত্ত্বাবধান করেন। এরপর তিনি আত্মহত্যার বৈধতা আদায়ে একটি এনজিও খোলেন, যার নাম দেন ‘এক্সিট ইন্টারন্যাশনাল’।
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যেও বৈধতা পেয়েছে ইনজেকশন দিয়ে আত্মহত্যা। তবে ১৮ বছরের বেশি কোন ব্যক্তি যদি এমন কোন রোগে আক্রান্ত হন, যাতে তার ৬ মাসের বেশি বাঁচার সম্ভাবনা নেই, তখনই এই ইনজেকশন ব্যবহার করা যাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৭
আপনার মতামত জানানঃ