চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কেশবপুরে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন ও পরবর্তী বিস্ফোরণের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)। সেই সাথে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার কারণে অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো ঘটছে বলে মনে করেন তারা।
তারা বলছেন, সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। এর অবর্ণনীয় ক্ষতি রাষ্ট্র তথা সাধারণ জনগণের ওপর ভয়ংকরভাবে নেমে এসেছে।
গতকাল মঙ্গলবার(০৭ জুন) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানিয়েছে আইপিডি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইপিডি মনে করে, কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণ, জীবন ও জীবিকার অপূরণীয় ক্ষতির পেছনে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের দায় আছে। একই ভাবে এই ধরনের রাসায়নিক কনটেইনার ডিপোর যথাযথ তদারকি, ব্যবস্থাপনা ও নজরদারির দায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ও রয়েছে।
আইপিডি বলছে, ব্যবসা, শিল্প ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসমূহের অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি নির্মাণ ও উন্নয়নের সময় ভবন ও কমপ্লেক্সের মধ্যে ইমারত সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা, ব্যবহারকালীন নিরাপত্তা, অগ্নি নিরাপত্তা ও দূর্যোগকালীন প্রস্তুতির বিরাট ঘাটতি আমাদের শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের নিরাপদ জীবন ও জীবিকাকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।
আইপিডি মনে করে, সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে বারবার এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণ প্রভৃতি ঘটনা রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, যার অবর্ণনীয় ক্ষতি রাষ্ট্র তথা সাধারণ জনগণের উপর ভয়ংকরভাবে নেমে এসেছে।
পূর্বাপর অগ্নি দূর্ঘটনার সময়, বিশেষতঃ নিমতলী, চুড়িহাট্টা, রূপগঞ্জ হাশেম ফুডস ফ্যাক্টরীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাসমূহের অব্যবহিত পরে রাষ্ট্র কর্তৃক এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ও রাসায়নিক দ্রব্যাদির নিরাপদ ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে করণীয়সমূহ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা ও দপ্তরগুলোর দায়-দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এটা বিস্ময়কর যে, এই ধরনের ঘটনাগুলোর হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা ধারণ করার পরেও আমাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখায়নি।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ডিপোতে আগুন ও পরবর্তী বিস্ফোরণের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়ে আইপিডি বলছে, এ ঘটনায় বিস্ফোরক অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন—সবারই দায়িত্ব পালনে গাফিলতির বিষয়টি আবারও সামনে উঠে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে যথারীতি দোষীদের আইনের আওতায় নেবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে বারবার এই ধরনের অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণ প্রভৃতি ঘটনা রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে, যার অবর্ণনীয় ক্ষতি রাষ্ট্র তথা সাধারণ জনগণের উপর ভয়ংকরভাবে নেমে এসেছে।
কিন্তু কাস্টমস সূত্রে এখন জানা যাচ্ছে, নিরাপত্তা ও যন্ত্রপাতির শর্ত পূরণ না করার কারণে ২০১৭ সালে বিএম কনটেইনার ডিপোর লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ রাখা হয়েছিল। ফলে বর্তমান এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর এই ডিপোটিতে এ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ খালাস ও মজুদে পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপকসহ সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি স্পট হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে এই ধরনের ডিপোতে ঝূঁকিপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থ থাকার বিষয়টি ফায়ার সার্ভিসের না জানা থাকার বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার চরম দূর্বলতার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছে আইপিডি।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ব্যবসা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাবের কারণে আমাদের দেশে আইনের শাসন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই শিথিলতা দেখা যায়, যা আমাদের শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের জীবনকে ভীষণভাবে বিপন্ন করে তুলেছে। আরো একটি বিষয় এখানে তাৎপর্যপূর্ণ, এই কনটেইনার ডিপোতে ইউরোপীয় দেশের বিনিয়োগ থাকলেও এখানে সে মানের কাছাকাছি অগ্নি নিরাপত্তা ও দূর্যোগ ঝূঁকি প্রশমনের তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
এই অগ্নিকাণ্ডের পর এই ডিপোতে ফায়ার হাইড্রেন্ট না থাকবার কারণে আশেপাশের পুকুর থেকে আগুন নেভানোর জন্য পানির সংস্থান করতে হয়েছে, যা দূর্যোগ মোকাবেলাকে প্রলম্বিত করেছে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) মনে করে, শিল্প কারখানা ও রাসায়নিক গুদাম-ডিপোগুলোকে যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও নিয়মনীতির মধ্যে নিয়ে এসে শ্রমিকের জীবন ও জীবিকার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিবিধান প্রতিপালনে শিল্প-কারখানা, গুদাম-ডিপোসমূহকে বাধ্য করবার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সাধারণ মানুষের দারিদ্র ও সস্তা শ্রমকে উপজীব্য করে কোনো প্রভাবশালী উদ্যোক্তা কিংবা গোষ্ঠী যেন মানুষের জীবনকে যেন এভাবে বিপন্ন করতে না পারে সেজন্য রাষ্ট্র ও সরকারকে আমাদের সংবিধানে প্রতিশ্রুত জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা দিতে প্রয়োজনীয় সকল উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। একইসাথে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে এই ধরনের ঘটনায় জীবন ও জীবিকার অপূরণীয় ক্ষতির প্রতিবিধান করতে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বার্তাটা সাধারণ জনগণের কাছে স্পষ্ট করা উচিত বলে বিশ্বাস করে আইপিডি।
বিজ্ঞপ্তিতে আইপিডির নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া শিল্পকারখানা ও রাসায়নিক গুদাম-ডিপোগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ভবন, কমপ্লেক্স, ইমারত তৈরি করা হচ্ছে। এসব স্থাপনায় ইমারতসংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা, ব্যবহারকালীন নিরাপত্তা, অগ্নিনিরাপত্তা ও দুর্যোগকালীন প্রস্তুতির বিরাট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আইনের শাসনের কথা বলার আগে আমাদের পরিষ্কার হওয়া দরকার, আইন প্রয়োগের দায়িত্ব আমরা যাদের হাতে দিয়েছি, তারা কারা? তারা কতটা জনবান্ধব। জনগণের করের পয়সায় বেতন হলেও সেই জনগণকে তারা যে নিয়মিত হয়রানি করেন, নাজেহাল করেন, ব্ল্যাকমেইল করেন, পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে মাদক আইনে মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেন, তারা কী আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন? সুতরাং, বাংলাদেশে আইনের শাসন আছে কী নেই বা কতটুকু আছে, তা বোঝার জন্য কয়েকটি ঘটনার দিকে তাকালেই হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩২
আপনার মতামত জানানঃ